বিশ্বাস হয়, এখনো আমি একটু একটু মাতাল? মনে হল এবার একটা ছোটখাটো পার্টি দিয়ে দেয়া যায়, কারণ এক সময় না এক সময় আমরা সার্থকভাবেই মিল… মিশ… ধ্যাৎ… মিলেছি বৃহস্পতির সাথে। এছাড়াও আমরা নতুন দুজন সদস্য পেয়েছি শিপে। চন্দ্র অ্যালকোহল পছন্দ করে না-এটা নাকি মানুষকে অতিমাত্রায় মানবিক করে ফেলে-কিন্তু ওয়াল্টার কার্নো সেটা কড়ায় গণ্ডায় পুষিয়ে দিচ্ছে। একমাত্র তানিয়াই কঠিন। সে কিছুতেই মাতাল হবে না-অ্যালকোহল নিক, না নিক… এমনটাইতো আশা করো ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে, না?
প্রিয় আমেরিকানরা-আমি কথা বলছি রাজনীতিকের মতো। ঈশ্বর সাহায্য করেছেন আমাকে-ভালয় ভালয় বেরিয়ে এসেছি হাইবারনেশন থেকে, তারপর বৃহস্পতির টান থেকেও। দুজনেই আছি কাজে নামার ধান্ধায়। আমাদের সবাইকে তাড়াহুড়ো করতে হবে। শুধু সময় যাচ্ছে না-ডিসকভারির অবস্থাও মনে হয় খারাপ। নিখুঁত সাদা শরীরটা হলদেটে হয়ে গেছে দেখে আমার বিশ্বাসই হতে চায়নি।
অবশ্যই দোষটা আইওর। শিপ বাঁকা পথে চাঁদটার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে নেমেছে তিন হাজার কিলোমিটার। আর প্রতিদিনই সেখানে দু-চারটা জ্বালামুখ কয়েক মেগাটন সালফার উগরে দেয় আকাশের দিকে। তোমরা অবশ্যই ছবি দেখেছ, কিন্তু এর উপর ঝুলে থাকা যে কতটা মানসিক চাপের ব্যাপার সেটা কল্পনাও করতে পারবে না। আমি ফিরে আসতে পারলেই বাঁচি, অথচ অপেক্ষা করছি এরচে রহস্যময় কিছু একটার জন্য। হয়ত জিনিসটা আইওর চেয়ে অনেক বেশি ভয়াল, কে জানে?
ছ নম্বর বিস্ফোরণের সময় আমি উড়েছিলাম কিলাওয়ার উপর, সেটাও ভয়ংকর, কিন্তু এর সাথে কোনো… কোনো দিক দিয়েই তুলনা করা যায় না। এখন আমরা রাতের আকশের উপর। রাতটাই মাটি। একটু দেখলেই অনেক ভাবার উপাদান পেয়ে যাবে। আমি যেমন দোযখে যাওয়ার ভয় পাই এটা দেখতে ঠিক তেমন…
অনেক সালফার লেকই আলো দেয়ার মতো গরম, কিন্তু আলোেটা আসে মূলত বিদ্যুৎ চমক থেকে। কয়েক মিনিট পর পরই মনে হয় উপগ্রহটা ফেটে পড়বে। যেন একটা দানবীয় ফটোফ্ল্যাশ এর উপর দিয়ে চলে যায়। উদাহরণটা খারাপ হল না, কী বল? আইও আর বৃহস্পতির সংযোগ হল বিরাট ফ্লাক্স টিউব। সেটা দিয়ে প্রতি মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ অ্যাম্পিয়ার বিদ্যুৎ বয়ে যায়। যখন তখন সেখানে কিছু না কিছু দুর্ঘটনা ঘটছেই। এরপর হঠাৎ সৌরজগতের সবচে বড় বিদ্যুৎ চমকের আলো দেখেই আমাদের সার্কিট ব্রেকারের অর্ধেক লজ্জা পেয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে।
ঠিক এখনো একটা বিস্ফোরণ হল, বিরাট এক মেঘ আসছে আমাদের দিকে, সূর্যালোকের সিঁড়ি বেয়ে। কবে যেন ধরেই ফেলে। অবশ্য ভয় নেই, এত উপরে উঠে ধরে ফেললেও আর তেমন ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু এই বিস্ফোরণের ক্ষুধার্ত মহাকাশের দানব-আমাদের না খেতে পারলে তার শান্তি নেই।
এখানে এসেই আমার মনে হল আইও কিছু একটা মনে করিয়ে দিতে চায়। দু দিন কাজ করেছি এ নিয়ে। শেষে মিশন আর্কাইভের সাহায্য নিতে হল-শিপের লাইব্রেরি কোনো কাজেই লাগেনি। মনে আছে, কীভাবে দ্য লর্ডস অব দ্য রিংস এর সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম দিমিত্রি? আমরা তখন ছোট, অক্সফোর্ড কনফারেন্সে ছিলাম। এই আইও হচ্ছে সেই মোরভোর, তৃতীয় অধ্যায়ে দেখ। সেখানে একটা প্যারায় লেখা, …গলা পাথরের নদী হয়ত তাদের পথ হবে… যে পর্যন্ত তারা শান্ত না হয়, মরা ড্রাগনের মতো কুঁচকে শুয়ে না পড়ে ব্যথায় ভরা বসুন্ধরায়। এ হল খাঁটি উদাহরণ। কীভাবে টোকেন পঁচিশ বছর আগেই আইওর খবর জানতো কে জানে! এটা প্রকৃতিকে নকল করে লেখা উপন্যাস হওয়ার কথা।
যাক, আমাদের সেখানে ল্যান্ড করতে হচ্ছে না। আমাদের চীনা সহকর্মীরা এমন করতে চাইলেও আমি তা ভাবতে পারি না। একদিন সম্ভব হতে পারে। কিছু কিছু এলাকা একেবারেই শান্ত দেখায়, সালফারের জোয়ার সেখানে কম।
কদিন আগে কে বিশ্বাস করতে পারত যে আমরা বৃহস্পতি ছাড়িয়ে ওপাশের কক্ষপথে এসে পৌঁছব সবচে বড় গ্রহকে হেলা করে! এবার আমরা তাই করছি। না বৃহস্পতি, না আইও, আর না ডিসকভারি। আমরা খুঁজছি সেই… আর্টিফ্যাক্টটা। কোনো এক সভ্য প্রাণীর বানানো কৃত্রিম একটা জিনিস, প্রাকৃতিক নয়। চাঁদেরটা নয়, বৃহস্পতিরটা।
ওটা এখনো দশ হাজার কিলোমিটার উপরে, মুক্ত এলাকায়। কিন্তু যখনি টেলিস্কোপ দিয়ে তাকাই, মনে হয় একেবারেই মসৃণ। যত কাছেই জুম করি না কেন, একই রকম মসৃণ-চোখে দেখে শেষ করা যায় না। দু কিলোমিটার লম্বা, যদি কঠিন হয়ে থাকে তো ওজন হবে শত শত কোটি টন।
আসলেই পুরোটা খাঁটি? এ থেকে কোনো রাডার প্রতিদ্বন্দ্বী হয় না। যখন আমাদের দিকে ফিরে থাকে তখনো না। আমাদের চোখে এটা তিন লাখ কিলোমিটার নিচের বৃহস্পতির মেঘের রাজ্যে বসিয়ে দেয়া কালো এক শ্লেট।
আকারের অনুপাতটা বাদ দিলে হুবহু সেই চাঁদের মনোলিথই যেন।
কালকে আমরা ডিসকভারিতে যাচ্ছি। তাই জানি না আবার কখন সময়-সুযোগ হবে কথা বলার। কিন্তু পুরোনো বন্ধু, শেষ করার আগে আরো একটা কথা বলার থাকে।
ক্যারোলিনের ব্যাপারে কিছু কথা… সে কখনোই বুঝতে চায়নি কেন পৃথিবী ছাড়তে হচ্ছে আমাকে। এ একটা ব্যাপারে ভয় পাই, ও হয়ত কখনোই আমাকে ক্ষমা করবে না। কোনো কোনো মেয়ে মনে করে ভালবাসাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না-বরং শুধু ভালবাসাই সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। হয়ত তারাই ঠিক… যেই ঠিক হোক, এখন আর এসব যুক্তি দেখানোর মানে নেই।