সবই ঠিকঠাক চলবে-জেনিয়া। জিয়াংপেরে থাকলে আমরাও পারব…রিল্যাক্স, ভয় পাবার কিছু নেই। এমন পরিবেশে নরম সুরে কথা বলা যথেষ্ট কঠিন, তবু সে শিওর না এত কান ফাটানো গর্জনের মাঝে জেনিয়া কথাটুকু শুনেছে কিনা।
তাপে তাপে উবে যাওয়া হাইড্রোজেনের চিৎকার বাড়ছেই। ভাগ্য ভাল, এখন আর সে তাকে চেপে ধরে রাখছে না। সুযোগ পেয়ে ফ্লয়েড ভাল মতো দম নিয়ে নেয়।
তাকে এ অবস্থায় দেখলে ক্যারোলিন কী ভাবত? কখনো সুযোগ পেলে সে কি এ সময়ের কথাটা স্ত্রীকে বলবে? শুনলে মেয়েটা তার কথা মানবে কিনা কে জানে!
এমন এক মুহূর্তে পৃথিবীর বন্ধনকে অনেক অনেক হাল্কা মনে হয়।
নড়া অসম্ভব। কথাও বলা যায় না। কিন্তু এরিমধ্যে সে ওজনের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সাথে তাল মিলিয়ে নিয়েছে–ওজন কখনোই তার কাছে কঠিন মনে হয় না; শুধু এখন ডান হাতটায় চাপ বাড়ছেই বাড়ছে। অসহ্য। বহু কষ্টে হাতটাকে উদ্ধার করে জেনিয়ার কাছ থেকে; কাজটা করেই কেমন অপরাধবোধে ছেয়ে যায় মন। হাতের রক্ত চলাচল ফিরে পেতেই তার মনে পড়ে কমপক্ষে এক ডজন অ্যাস্ট্রোনট আর কসমোনটের বিখ্যাত উক্তিটা, জিরো গ্র্যাভিটি সেক্সের আনন্দ আর সমস্যা দুইই খুব বেশি।
কীভাবে বাকি ক্রুরা চলছে কে জানে! একই সাথে তার হিংসাও হয় চন্দ্র আর কার্নোকে, পুরো পথটাই ঘুমিয়ে কাটালো ওরা-দুশ্চিন্তা আর মানসিক চাপ পরের কথা, ঘুমিয়েছে যে তাই টের পায় না। বৃহস্পতির আকাশে লিওনভ যদি একটা উল্কা হয়ে ঝরে পড়ে তবু তারা কোনোদিন জানতে পারবে না। হঠাৎ হিংসাটা কেটে গেল, তারা জীবনের এক বিরাট অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হল আজ।
তানিয়া ইন্টারকমে কথা বললেও গর্জনের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে তার শান্ত আর খুবই স্বাভাবিক কথাবার্তা। কথা এতই শান্ত যেন কোনো রুটিন এনাউন্সমেন্ট চলছে। ফ্লয়েড হাতঘড়ির দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে নেয়, অবাক ব্যাপার! পেরিয়ে গেছে অর্ধেক পথ। ঠিক এ মুহূর্তে লিওনভ বৃহস্পতির সবচে কাছাকাছি। শুধু এক্সপান্ডেবল অটোমেটিক প্রোবগুলো বৃহস্পতির আকাশের আরো ভিতরে ঢুকে যাবে।
অর্ধেক পথ শেষ, জেনিয়া। চিৎকার করে ওঠে সে, এবার বেরিয়ে যাব। কে জানে, মেয়েটা শুনেছে কিনা। তার চোখগুলো একেবারে বন্ধ, একটু হাসল শুধু।
বোঝাই যায় শিপ দুলছে কোনো উন্মাদ সাগরে ছোট্ট নৌকার মতো। এমন হবার কথা? ভয় পায় ফ্লয়েড। জেনিয়াকে নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ পেয়ে সে যথেষ্ট খুশি; নিজের ভয়কে অনেক দূরে সরিয়ে দেয়া গেল। এ চিন্তাটা সরিয়ে দেয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সে দেয়ালগুলোকে চেরির মতো আগুন রঙা হয়ে যেতে দেখল, কুঁকড়ে আসছে তার দিকে। এডগার অ্যালান পোর সেই দুঃস্বপ্ন ফ্যান্টাসি, দ্য পিট অ্যান্ড দ্য পেন্ডুলাম এর মতো যেটার কথা সে ভুলে ছিল গত ত্রিশ বছর…
কিন্তু এমন কিছু কখনোই হবে না। হিট শিল্ড ব্যর্থ হলে সাথে সাথেই শিপ দুমড়ে যাবে। সামনের গ্যাস স্তর পৃথিবীর মতো নয়, বৃহস্পতির বায়ুস্তর যেন শক্ত দেয়াল। কোনো ব্যথা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। স্নায়ুতন্ত্র এ অনুভূতি বহন করার আগেই ছাই হয়ে যাবে। সে সান্ত্বনার আরো অনেক শব্দ খুঁজে পায়, কিন্তু চিন্তাটা তাড়ানো অসম্ভব।
উত্তেজনা থিতিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। তানিয়া আরেকটা ঘোষণা দেয় এবার (সব শেষ হলে সে নিশ্চই এ ঘোষণার জন্য ক্যাপ্টেনকে দেখে নেবে।) এবার সময় যেন আরো আরো ধীর; এক সময় ঘড়ির দিকে তাকানো বন্ধ করে দেয়। এ ঘড়িকে আর বিশ্বাস করা যায় না। ডিজিট এত আস্তে আস্তে পরিবর্তন হচ্ছে যেন সে স্পষ্ট নিজেকে কোনো আইনস্টাইনীয় সময় দীর্ঘায়নের ফাঁদে দেখতে পায়।
এরপর আরো অবাক করা কিছু হয়। প্রথমে একটু মজা পেলেও রেগে যায় ধীরে ধীরে। জেনিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে-তার হাতে না হোক, একেবারে হাতের পাশে।
এই স্বাভাবিক। এত চাপ আর উত্তেজনা মেয়েটাকে নিশ্চই ক্লান্ত করে তুলেছে-কিন্তু শরীরের সৌন্দর্য তাকে ফ্লয়েডের রাগের হাত থেকে বাঁচায়। হঠাৎ ফ্লয়েড নিজেও ঝিমাতে শুরু করে শারীরিক আনন্দের পর যে অবসাদ আসে তার কারণে, যেন সেও এই মুখোমুখির জন্যে ডুবে গেছে অনেকটা। তাকে জেগে থাকতেই হবে…
…আর সে পড়ে যাচ্ছে… পড়ছে… পড়ছে… সব শেষ। শিপ ফিরে এসেছে মহাকাশে; যেখানে তার থাকার কথা। আর মাধ্যাকর্ষণ নেই। আলাদা হয়ে ভেসে বেড়ায় সে আর জেনিয়া।
তারা হয়ত আর কক্ষনো এত কাছে আসবে না কিন্তু সারা জীবন একে অন্যের প্রতি অন্যরকম এক কোমলতা নিয়ে চলবে যা আর কারো সাথে শেয়ার করা অসম্ভব।
১৫. দৈত্য থেকে দূরে
জেনিয়ার মাত্র কয়েক মিনিট পরে ফ্লয়েড অবজার্ভেশন ডেকে পৌঁছল। বৃহস্পতি এর মধ্যেই সরে গেছে অনেক দূরে। যা দেখেছে সে সময় না, তা অবশ্যই কোনো বিভ্ৰম-চোখের প্রমাণ নয়। বৃহস্পতির অ্যাটমোস্ফিয়ার থেকে তারা দূরে। কিন্তু এখনো গ্রহটা অর্ধাকাশ জুড়ে রয়েছে।
এখন তারা গ্রহরাজের হাতে বন্দী। শেষের জ্বলন্ত ঘণ্টাগুলোয় ভালমতো চিন্তা ভাবনা করেই জলাঞ্জলি দিয়েছে বাড়তি গতি। এ গতিটা সৌরজগতের ঠিক বাইরে অনন্ত নক্ষত্রবীথির মাঝে নিয়ে ফেলতে পারত। এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে এক উপবৃত্তাকার পথে। এক পরিচিত হোম্যান কক্ষপথ। হয়ত তাদের উপরদিকে সাড়ে তিন লাখ কিলোমিটার পিছিয়ে নিতে পারে। সেটা বৃহস্পতি আর আইওর মাঝামাঝি অর্বিট। তা করতে না পারলে ভাল। না করলে আবার মোটরগুলো জ্বালাতে হবে। লিওনভ ঘুরে বেরিয়ে যাবে এবং মরণের সেই দুই সীমার মুখোমুখি হবে আবার। বারবার কষ্ট করে বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে ঢুকবে, বেরিয়ে যাবে প্রতি উনিশ ঘণ্টা অন্তর অন্তর। এ অর্বিটটা বৃহস্পতির চাঁদগুলোর কাছাকাছি যেতে পারে তবে খুব বেশিক্ষণের জন্য নয়। যতবার যানটা অ্যাটমোস্ফিয়ারে ঘোরাঘুরি করবে ততোবারই হয়ত এর উচ্চতা যাবে কমে, যে পর্যন্তসর্পিল আর ছোট হতে থাকা পথটা ধ্বংসের দিকে না গড়ায়।