অডিও চিপ সরিয়ে ফ্লয়েড ভেসে চলল কম্যুনিকেশন সেন্টার থেকে বেরিয়ে। তারপর চিপটা শাসা কোভালভের হাতে দিয়ে দিল, প্লিজ, মেসেজটা যেন ডিশ নামানোর আগেই পাঠানো হয়। পাঠিয়েই জানিয়ে দিও আমাকে।
চিন্তা করো না। শাসা জবাব দিল, আমি এখনো সব চ্যানেলে চেষ্টা করছি। হাতে জলজ্যান্ত দশ মিনিট বাকি।
আবার যদি দেখা হয়-আমরা তো হাসব। যদি তা নাই হয়, কেন এ বিদায় এত সুন্দর করে হল?, কথাটা বলার আগে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ফ্লয়েড। বলা শেষ করেই একচোখ একটু পিটপিট করল।
শেক্সপিয়র-ঠিক?
অবশ্যই; ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াসের কথা। যুদ্ধের আগে। শাসা, দেখা হবে তোমার সাথে।
তানিয়া আর ভ্যাসিলি নিজেদের কাজে এত বেশি মনোযোগী ছিল যে ফ্লয়েডের দিকে তারা সেভাবে খেয়ালও করল না। সে সবকিছু ছেড়ে সেঁধিয়ে গেল নিজের সেই ছোট্ট কেবিনেই। সবার কাছ থেকেই বিদায় নেয়া হল। এখন অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তার স্লিপিং ব্যাগ প্রস্তুত। আবার মহাকর্ষ শুরু হলে স্লিপিং ব্যাগে ঢোকার মতো একমাত্র লোক সে।
অ্যান্টেনাগুলো… ইন্টারকম স্পিকার বলে উঠল, আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রথম অভিকর্ষ অনুভব করব, আশা করি। সবকিছুই নরমাল।
এ শব্দটাই আমি সবচে কম ব্যবহার করি, বলল ফ্লয়েড। নিজেকেই, আমার মনে হয় তোমরা নরমাল শব্দটা বলেছ ভুল করে, হয়ত বলতে চাইছ নোমিনাল বা নামমাত্র।
হঠাৎ করেই নিজের চিন্তা থামিয়ে দিল ফ্লয়েড। দরজায় জোর শব্দ হচ্ছে। প্রশ্ন করল, কটো টম?
মনে হল জেনিয়া এসেছে।
আমি ভিতরে এলে কি তুমি কিছু মনে করবে? জিজ্ঞাসাটা ন্যাকা সুরের। অবশ্যই ছোট্ট মেয়ের কণ্ঠে; ব্যাপারটা ফ্লয়েড বুঝতে পারে ভয়ার্ত মনে।
অবশ্যই কিছু মনে করব না। তুমি নিজের কিউবিকলের বাইরে কেন? এলাকায় ঢুকতে আর পাঁচ মিনিটও বাকি নেই। প্রশ্নটা করলেও নিজের বোকামীর ব্যাপারে সচেতন ছিল ফ্লয়েড। জবাবটা এত বেশি অদরকারি যে জেনিয়া তা দেয়ার কোনো চেষ্টাই করেনি।
কিন্তু জেনিয়াই সর্বশেষ মানুষ যাকে ফ্লয়েড হয়ত আশা করে থাকবে। তার প্রতি জেনিয়ার আচরণ সব সময়েই নস্ত্র কিন্তু দৃঢ়তাও ঠিক থাকত। এমনকি সমস্ত ক্রুর মধ্যে একমাত্র ও-ই ফ্লয়েডকে ডক্টর ফ্লয়েড নামে ডাকতে পছন্দ করে। ঠিক এখনো, দুর্দশার মুহূর্তে সে একটু আয়েশ আর সঙ্গই হয়ত আশা করে এখানটায়।
জেনিয়া, মাই ডিয়ার সে বিকৃত সুরে বলল, তোমাকে স্বাগতম, কিন্তু আমার থাকার জায়গাটা খুব ছোট। এটাকে কেউ ইচ্ছা করলে স্পার্টা নগরীর মতোও বলতে পারে।
মেয়েটা কোনোমতে একটা ফ্যাকাশে হাসি দিয়ে কোনো কথা না বলেই ঘরে ঢুকল ভেসে ভেসে। আর প্রথমবারের মতো ফ্লয়েড দেখতে পেল ও শুধু নার্ভাস না, রীতিমতো আতঙ্কিত। এতক্ষণে বুঝতে পারছে কেন মেয়েটা এসেছে তার কাছে। এ অবস্থায় নিজের সহযোগীদের কাছে যেতে লজ্জা পাচ্ছিল বলেই ভেসে বেড়াচ্ছে। একটু সমর্থনের আশায়।
ও হঠাৎ ঢুকে যাওয়ায় অবশ্যই ফ্লয়েডের রাগ ওঠার কথা। জেনিয়ার অসহায়ত্ব বুঝতে পেরেই রাগটা মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। বাড়ি থেকে অকল্পনীয় দূরে থাকা একা একজন মানুষ এমন কোথাও ঢুকবে একটু পর যেখান থেকে কেউ বেঁচে ফেরেনি। এবং সেই ঢোকারও কোনো নিশ্চয়তা নেই, কেউ জানে না তারা অসীম স্পেসে হারিয়ে যাবে নাকি জ্বলে ছাই হবে বৃহস্পতির দিকে পড়তে পড়তে। এত বিরক্ত হয়নি ফ্লয়েড যার ফলে তার এটুকু বোঝার ক্ষমতা কমে যাবে। জেনিয়া ঠিক অপরূপা না হলেও আকর্ষণীয়। কিন্তু তার অর্ধেক বয়েসী কোনো মেয়ের ক্ষেত্রে এসব কোনো ব্যাপার না। এটাই হয়েছিল; সে ভাবতে বসেছিল ঐরকম কিছুই। ফ্লয়েড একটু আড়ষ্ট।
জেনিয়া অবশ্যই বুঝতে পারে সব। কোকুনে পাশাপাশি শুয়ে থাকার সময় মেয়েটা উৎসাহ অনুৎসাহের কোনোটাই দেয় না। তাদের দুজনের জন্য মোটামুটি স্থান থাকলেও ফ্লয়েড জায়গা নিয়ে হিসাব নিকাশ শুরু করে দিয়েছিল। তার সবচে ভয়ের হিসাবটাও মাথায় আসে, যদি সর্বোচ্চ অভিকর্ষ পরিকল্পনার চেয়ে একটুও বেশি হয়…সহ্য ক্ষমতার চেয়ে বেশি হলে? তারা মারা যেতে পারে সাথে সাথে…
দুজনের দূরত্বটা মোটামুটি ভদ্র, হঠাৎ এ পরিস্থিতিতে পড়ায় লজ্জার কিছু নেই। মনের অবস্থার সাথে কামনার কোনো মিলই নেই এখন; কোন ফাঁকে তাদের আলিঙ্গন এত কাছাকাছি এসেছে টেরও পায়নি কেউ। ফ্লয়েড জানে না এতে দুঃখ পেতে হবে নাকি সুখ।
এখন আর অন্য চিন্তার সময় নেই। অনেক অনেক দূর থেকে ভেসে এল মৃদু শব্দের প্রথম ফিসফিসানি; যেন কোনো অশান্ত আত্মার হাহাকার। একই মুহূর্তে শিপ বেশ স্পষ্টভাবে ঝাঁকি খায়; এপাশ ওপাশ দুলতে থাকে কোকুন। প্রথমবারের মতো তারা আকর্ষণ টের পায়। কোকুন আঁকড়ে রেখেছে তাদের। বহু সপ্তাহের ওজনহীনতার পর ফিরে আসছে গ্র্যাভিটি।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেই হালকা ফিসফিস পরিণত হয় এক নিয়মিত উঁচু শব্দে। এবার কোকুনটার অবস্থা ঠেসে ভরা নেটের ঝুলন্ত বিছানার মতো। ব্যাপারটা ভাল হচ্ছে না…ভাবল ফ্লয়েড। এখনি শ্বাস নেয়া কষ্টকর। তার শ্বাস নেয়ার কষ্ট গ্র্যাভিটির জন্য নয়, জেনিয়া তাকে আঁকড়ে ধরেছে-যেভাবে ডুবন্ত মানুষ আঁকড়ে থাকে সামান্য খড়কুটোকে। সে মেয়েটাকে সরিয়ে দিল যতটা ভদ্রভাবে পারা যায়।