লিওনভ যখন প্রচণ্ড গতিতে আইও এবং ছোট্ট মিমাসের কক্ষপথগুলো ছাড়িয়ে গেল তখন আলোচনা এমনকি এগুলোর সম্পর্কে অনুমানেরও সময় ছিল না। সবাই ব্যস্ত রাজকীয় এলাকার ওজন বেড়ে যাওয়ার ছোট সমস্যাটার ব্যাপারে। বৃহস্পতির টান যে অসম্ভব! ঘণ্টা কয়েক পরে আসবে মুক্ত পতন। বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের আগেই সব আলগা জিনিসপত্র নিরাপদে রাখাটা জরুরি। মুহূর্তের মধ্যে মন্দনের কারণে টেনে চলাটা শুরু হয়। এজন্য হয়ত বড়জোড় টু জির মতো তীব্র ওজন বোঝা যাবে।
ফ্লয়েডের ভাগ্য ভালই; সে একাই পেয়েছে আসতে থাকা গ্রহের অপার্থিব দৃশ্যের প্রশংসা করার সময়-সুযোগ। এরই মধ্যে আকাশের অর্ধেকটা গ্রহরাজের দখলে। একে মাপার মতো কোনো নিক্তি নেই। বিবশ মনের পক্ষে প্রকৃত আকারটা ধরে রাখারও উপায় নেই কোনো। তার নিজেকেই বারবার বলতে হচ্ছে যে অর্ধশত ধরণীও এ গোলার্ধকে ভরে দিতে পারবে না যা তার দিকে এগিয়ে আসছে নিয়তির মতো।
পৃথিবীর সবচে দামি সূর্যাস্তের মতো দেখায় ভাগ্যপতির মেঘমালা; এত দ্রুত ছুটে বেড়ায় যে দারুণ নড়াচড়া দেখা যায় বড়জোর দশ মিনিট; তারপরই হারিয়ে যায় ওপাড়ে। দানবীয় ঘূর্ণিগুলো থেকে থেকে জন্ম দিচ্ছে ডজন ডজন ছোট ঝড়। অথবা আরো বড় বড় দল। এ দল আর মেঘ ঘিরে থাকে দানো গ্রহকে। ঢেউ খেলিয়ে চলে যায় ধোয়ার চক্রের মতো। সাদা গ্যাসের শিখা মাঝে মাঝে গভীর থেকে উষ্ণ প্রস্রবনের মতো উথলে ওঠে আবার বৃহস্পতির ভয়ানক পাক খাওয়া ঝড়ে সরে যায় দূর থেকে দূরে। সাদা চিহ্নগুলো সবচে অদ্ভুত, দেখতে নেকলেসের গায়ে সাজানো মণিমুক্তার মতো। অবাধ বাতাসের সাথে শুয়ে আছে বৃহস্পতির মাঝামাঝি.অক্ষাংশ জুড়ে।
দ্বীপরাজ্যের রাজধানীর শহরতলীতে ঢোকার আগের কয়েক ঘণ্টায় ফ্লয়েড ক্যাপ্টেন আর নেভিগেটদের দেখল খুব কমই। অর্লোভরা ব্রিজ ছেড়ে যায় না কারণ তাদের কাজটা খুব কঠিন। বৃহস্পতির এলাকায় অনেক অনেক অর্বিট। ওরা তাই আসতে থাকা কক্ষপথকে পরীক্ষা করছে আর মিনিটে মিনিটেই বদলে দিচ্ছে লিওনভের পথ। এ মুহূর্তে শিপের রাস্তা খুব জটিল। এখনি বাইরের বায়ুমণ্ডলে ঢুকবে; যদি স্পিড অনেক বাড়ে তাহলে ফ্রিকশনাল ব্রেক করাটা অসম্ভব হতে পারে। এমনকি, উপরের দিকে উঠে পড়লে বৃহস্পতি-অর্বিটের আকর্ষণ কাজে লাগিয়ে দোলনার মতো শিপটা হারিয়ে যাবে সৌরজগতের বাইরে। ঐ শূন্যতা থেকে লিওনভকে উদ্ধার করাটা অসম্ভবই শুধু না, পথের আশা হবে অলীক কল্পনা। আবার যদি অনেক নিচু হয়ে যায়-পড়তে থাকে বরাবর বৃহস্পতির দিকে তাহলে অ্যাটমোস্ফিয়ারের কণার সাথে অতি গতিতে সরাসরি ঘর্ষণের কারণে স্রেফ পুড়ে যাবে এক উল্কাপিন্ডের মতো। এ দুই ভয়াল শেষ সীমার মাঝের ছোট্ট অঞ্চলে থাকতে পারলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে খুব অল্প।
চীনারা আগেই প্রমাণ করেছে যে অ্যারোব্রেকিং করা সম্ভব। কিন্তু সব সময় দু একটা ভুলের সুযোগ থেকে যায়। তাই ফ্লয়েড একটুও আমল দেয়নি সার্জন কমান্ডারের কথায়। সার্জন কমান্ডার রুডেস্কো যোগাযোগের এক ঘণ্টা আগে প্রশংসা করেছিল, উডি, আশা করা শুরু করলাম যে অবশেষে ধরা দিচ্ছে সেই বিজয়।
১৪. মুখোমুখি
…নান্টাকেট হাউসের বন্ধকের কাগজপত্র এম মার্ক করে ফাইলের মধ্যে নিয়ে লাইব্রেরীতে রাখতে হবে।
ঠিক আছে, আমার মনে হয় এটুকুই আমাদের আলোচনা। কয়েক ঘণ্টা ধরে মনে পড়ছে একটা ছবির কথা। আমি এক ছোট্ট ছেলের ছবি পেয়েছিলাম ভিক্টোরিয়ান আর্টের ছেঁড়া ভলিউমে। কমসে কম দেড়শো বছরের পুরনো। সাদাকালো নাকি রঙিন তা খেয়াল নেই। কিন্তু কখনোই ঐ ছোট্টটাকে ভুলব না–হাসবে না কিন্তু শুনে… ছবিটাকে দি লাস্ট মেসেজ হোম নামে ডাকত লোকে। আমাদের দাদার দাদারা পছন্দ করতেন ঐ ধরনের আবেগিক মেলোড্রামা।
চিত্রটায় হ্যারিকেনের মুখে পড়া এক জাহাজ দেখা যায়। পালগুলো ফোলা। ডেকে পানি আর পানি। পেছনে ক্রুরা জাহাজকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করছে আর সামনের দিকে এক তরুণ নাবিক হাতে কাগজ নিয়ে লিখছে একটা নোট। তার পাশেই রাখা আছে খালি বোতল। তার বিশ্বাস, এ ছিপিবন্ধ বোতল নোটটাকে নিয়ে কোনো এক সবুজ মাটির বুকে আছড়ে পড়বে কোনো একদিন।
তখন আমি ছিলাম একটা বিচ্ছু, ভেবেছি চিঠি লেখা বাদ দিয়ে তার উচিত ছিল সহযোগীদের সাহায্য করা। একইভাবে এটা আমার উপরেও এসে পড়তে পারে তাতো ভাবিনি কোনোদিন! ভাবিনি আমিই ঐ নাবিক।
অবশ্যই-আমি শিওর তুমি মেসেজটা পাবে। কিন্তু আমিতো লিওনভে কোনো সহযোগিতাই করতে পারব না। আসলে আমাকে ঐ কাজ থেকে দূরে থাকার জন্য খুব ভদ্রভাবেই বলা হয়েছে। আমি এ কথাটা বলার সময় আমার বিবেক পুরোপুরি সচেতন।
এখন মেসেজটা ব্রিজে পাঠাব। কারণ পনের মিনিটের মধ্যে সম্প্রচার শেষ হবে। বড় ডিশটা নামিয়ে বন্দী করব হ্যাঁচের ভেতরে। স্পেসশিপের সাথে সুন্দর মিল আছে তোমার! বৃহস্পতি ঠিক এ মুহূর্তে ভরে ফেলছে আকাশটাকে। সেটা আর বর্ণনা করার চেষ্টা করব না। সৌন্দর্যটা বেশিক্ষণ দেখবও না-কয়েক মিনিটের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শাটার।
যাই হোক, ক্যামেরাগুলো এরচে অনেক ভাল দেখতে পারে। বিদায় প্রিয়তমা। …..: তোমাদের সবার জন্য অনেক অনেক ভালবাসা। বিশেষ করে ক্রিসের জন্য। যখন এটা পাবে, ততোক্ষণে এগিয়ে গিয়ে চলাটা শেষ হবে; তা সোজা পথে হোক আর উল্টো। মনে রেখ, আমাদের সবার খাতিরে আমি চেষ্টা করেছি যথাসাধ্য। বিদায়।