ব্যাপার-স্যাপারে পরিবর্তন আসতে পারে, ফ্লয়েড তার সহকর্মীদের বলল কার্নো আর চন্দ্র হাইবারনেশন থেকে উঠে এলে। সে তার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপারে বলল না যে, কার্নো জাহাজের অন্য সবার চেয়ে বেশি চেঁচামেচি করতে ও কথা বলতে পারে।
ঘুমানো ছাড়া ফ্লয়েডের বেশির ভাগ সময়ই কাটত কমনরুমে। কিছুটা একারণে-ছোট হলেও এটা অনেক খোলামেলা; অন্তত তার ছোট্ট চৌকোণা ঘর থেকে বড়। সুন্দরভাবে সাজানো। সমস্ত সমতলই ছবি দিয়ে ভরা। সুন্দর ভূমি, সামুদ্রিক ছবি, খেলার ওয়ালপেপার, জনপ্রিয় চলচ্চিত্র তারকা আর পৃথিবীর আর সব সুন্দরের ছবি দিয়ে সাজানো এ ঘরটা।
ঘরের একদিকে ঝুলছে লিওনভের ছবি। ১৯৬৫ সালে তার নিয়ার দ্য মুন স্টাডিটা করা হয়েছিল যখন তিনি একজন তরুণ লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে ভস্কট দু কে ফেলে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যানবিহীন সংক্ষিপ্ত মহাকাশ অভিযান করেন।
স্পষ্ট বোঝা যায় যে মেধাবী অপেশাদার লোক একজন পেশাদারের চেয়ে ভাল কাজ করে। চাঁদের জ্বালামুখময় প্রান্তর, সুন্দর সাইনাস ইরিডিয়াম ও বে অফ রেইনবো দেখে ব্যাপারটা চোখে পড়ে। চাঁদের খাড়া উপরে দানবীয় উজ্জ্বলতায় জ্বলছিল পৃথিবী। নতুন চাঁদের মতো দেখায় এ গ্রহ। বসুধা রাতের দিকের বাকি আঁধার অংশটুকুকে আঁকড়ে আছে। এছাড়াও করোনার আলোক প্রবাহ মহাশূন্যে লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার দূরে পৌঁছে যাচ্ছে সূর্যের আশীর্বাদ হিসেবে। দারুণ লড়াকু কম্পোজিশন। ভবিষ্যতের এক ক্ষণিক আলোও যেন পড়ছে যা তখন থেকেই তিন বছর পরে সত্যি হয়ে যায়।
অ্যাপোলো আটের উড্ডয়নে এন্ডার্স, বর্মণ ও লভেল রাজকীয় দৃশ্যটা খালি চোখে দেখেছিল ক্রিসমাস ডে উদযাপন করার সময় দূরে পৃথিবীর উদয় হচ্ছে তখন। তারা ছিল চাঁদের বুকে। উনিশো আটষট্টিতে।
হেউড ফ্লয়েড এ চিত্রটাকে খুব উঁচু দরের কাজ মনে করে। কিন্তু ছবিটার ব্যাপারে তার ধারণা ছিল মিশ্র। সে ভুলতে পারল না যে পেইন্টিংটা শিপের আর সবার চেয়ে বয়সে বড়। ব্যতিক্রম মাত্র একজন। যখন অ্যালেক্সি লিওনভ এটা আঁকেন, ফ্লয়েড ছিল ন বছরের এক ছেলে।
১৩. গ্যালিলিওর ভুবনগুলো
এমনকি এখনো, প্রথম ভয়েজারের উড়ে যাবার তিন দশকেরও পরে কেউ আসলে বুঝতে পারেনি কেন ঐ চার দৈত্য-চাঁদ একে অন্যের সাথে এত দূরত্ব বজায় রেখে চলে। তাদের সবাই প্রায় একই আকৃতির এবং সৌর জগতের একই অংশে অবস্থিত-তবু পুরোপুরি আলাদা প্রকৃতির। ঠিক যেমন হয় ভিন্ন জন্ম নেয়া চার বাচ্চার বেলায়।
ক্যালিস্টো সবচে বাইরের উপগ্রহ। শুধু ওটাই প্রত্যাশা মাফিক সাজানো। লিওনভ এটাকে মাত্র লাখখানেক কিলোমিটার দূরে রেখে এগিয়ে যায়। এর অসীম জ্বালামুখের মধ্যে বড়গুলো দেখা যাচ্ছিল একেবারে খালি চোখেই। টেলিস্কোপের মধ্য দিয়ে উপগ্রহটাকে বিশাল কাঁচের গোলক মনে হয়। কাঁচের বলটা যেন শক্তিশালী রাইফেলের গুলিতে একেবারে ঝাঁঝড়া। যেন টার্গেট প্র্যাকটিস করা হয়েছে ঘুরতে থাকা গোলায়। সব আকারের জ্বালামুখে ভরা; একেবারে দৃষ্টি সীমার শেষপ্রান্ত পর্যন্ত। কেউ একবার বলেছিল চাঁদকে যতোটা না পৃথিবীর চাঁদের মতো দেখায় তার চেয়ে বেশি দেখায় ক্যালিস্টোকে।
অবাক করা কোনো কথা না। অ্যাস্টরয়েড বেল্টের এক প্রান্তে বসে যে কেউ নিজের অন্য প্রান্তের একটা জগৎ এখানে আশা করতেই পারে। কিন্তু এ অশটায় শুধুই আঘাত করে সেই ধ্বংসাবশেষ যেটাকে সৌর জগতের সৃষ্টি থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। অ্যাস্টরয়েড বেল্ট।
পরের উপগ্রহ গ্যানিমিডের চেহারা পুরোপুরি অন্যরকম। পেছনেরটার জ্বালামুখময় বিশাল প্রভাব এর উপর পড়ার কথা, তবু এর জ্বালামুখের বেশিরভাগই যেন চাষ করা-অদ্ভুত হলেও এ কথাটাই খাটে। গ্যানিমিডের বিস্তৃত অঞ্চল পিঠের মতো সমতলে ঢাকা। আবার কিছুটা মহাজাগতিক লাঙলে চষা জমি যেন। যেন কোনো বিরাট চাষী এ দৈত্যাকার চিরুনিচেরা পথ চষেছে কোন্ কালে। সেখানে হালকা রঙা বিচিত্র বর্ণের গর্ত, যেন স্ল্যাগ শামুক অর্ধশত কিলোমিটার দীর্ঘ পথটা বানিয়েছিল দুলকি চালে চলতে চলতে। সবচেয়ে রহস্যময় দাগগুলো লম্বা একেবেঁকে যাওয়া ভোরার দল-ডজন ডজন সমান্তরাল রেখা।
নিকোলাই টার্নোভস্কি বলে, এ লাইনগুলো অবশ্যই কোনো মাতাল অভিযাত্রী দলের বানানো বহু লেনওয়ালা সুপার হাইওয়ে।
সে দাবী করে টেলিস্কোপে দেখেছে ওভারসীজ এমনকি তার চোখে পড়ে লেন পৃথককারী পাতলা গাছের সারি।
মানব জ্ঞান ভাণ্ডার থেকে লিওনভ কয়েক ট্রিলিয়ন বিট তথ্য যোগাড় করেছে গ্যানিমিড সম্পর্কে। ইউরোপার কক্ষপথ পেরুবার আগেই এ ডাটা যোগাড় করে স্পেসশিপটা। ইউরোপা-সেই বরফ বাঁধানো দুনিয়া তার দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আর সবগুলো লাশ নিয়ে বৃহস্পতির অন্যপাশে থাকলেও কারো মন থেকেই দূরে নয়।
পৃথিবীতে খবর যাওয়ার সাথে সাথেই ডক্টর চ্যাং একজন জাতীয় বীরের সম্মান পান আর তার দেশের মানুষ স্বাভাবিক হতবুদ্ধি অবস্থায় পাঠায় অসংখ্য শোকবার্তা। একটা পাঠানো হয়েছিল লিওনভের ক্রুদের নামে। শিপে থাকার সময় সবার মানসিক অবস্থাই টলায়মান-প্ৰশংসা, দুঃখ আর মুক্তির মিশ্রণ চারদিকে। সব নভোচারী নিজেদের জাতীয় পরিচয়ের ব্যাপারে অবচেতন থেকে নিজেকে মহাশূন্যের নাগরিক মনে করে। একটা সাধারণ বন্ধনও অনুভব করে নিজেদের মধ্যে। তবু লিওনভের যাত্রীরা বিজয় বা দুঃখে অংশ নেয়নি তেমনভাবে কারণ চৈনিক