কিন্তু বৃহস্পতি দ্বিতীয় স্তরের চার উপগ্রহকে ঠিকই নিজের কজায় রাখবে যেগুলো প্রথম চারটার অর্ধেক দূরত্বে দোলায়মান। ইলোরা, লিসিথিয়া, হিমালিয়া ও লিডা সুন্দরভাবেই একে অন্যের কাছাকাছি এবং একই দূরত্বে আবর্তন করছে। মানুষ মনে করে যে, এ চার বোন এক সময় এক ছিল। তাই হয়ে থাকলে মূল দেহটা অন্তত শত কিলোমিটার বিস্তৃত হওয়ার কথা। শুধু ক্যারমে ও লিডা এত কাছে এসেছে যাতে নগ্ন চোখে তাদের একটা চাকতির মতো দেখা সম্ভব। তারা পুরনো বন্ধুর মতো আজো একে অন্যের সাথে মিলে মিশে থাকে।
দীর্ঘতম সাগর অভিযানের পর বৃহস্পতি দ্বীপপুঞ্জের জলসীমায় এই তাদের প্রথম প্রবেশ। শেষের ঘণ্টাগুলো উড়ে পালালো; পুরো অভিযানের জটিলতম স্তর সামনে। বৃহস্পতির অ্যাটমোস্ফিয়ারে প্রবেশ করার মতো জটিল কাজ করতে হবে। এর মধ্যেই বৃহস্পতি পৃথিবীর আকাশের চাঁদের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়। ভিতরের দিকের দৈত্য-উপগ্রহগুলিকে স্পষ্ট দেখা যায় গ্রহরাজের চারপাশে ঘুরতে। তাদের সবাইকে চাকতির মতো দেখায় এমনকি প্রত্যেকে নিজস্ব রঙও প্রকাশ করে যদিও এখনো তারা ঘুরে বেড়ায় দেখা না যাওয়ার মতো দূরত্বে। তাদের মহাজাগতিক ব্যালে নাচ চলছে ভাগ্যপতির পেছনে লুকিয়ে পড়া আর সূর্যের আলোয় বেরিয়ে আসার মাধ্যমে। নাচের সঙ্গী নিজ নিজ ছায়া। এবং এটাই সৃষ্টি জগতের জন্য সেই বুক কাঁপানো চিরন্তন ও স্থায়ী দৃশ্য। এটাই সেই সৃষ্টি, যা চারশো বছর আগে গ্যালিলিও একপলক দেখার পর থেকে আজ পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখে আসছেন। কিন্তু লিওনভের কুরাই একমাত্র জীবিত নর-নারীর দল যারা এ গ্রহকে নগ্ন চোখে দেখেছে। কথাটাকে কি অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? গ্রহরাজ তাকে খোলা চোখে দেখে নেয়ার স্পর্ধা দেখানো কোনো তুচ্ছ মানুষের জীবনই বাঁচিয়ে রাখেন না!
অসীম দাবাখেলা বন্ধ হয় শেষে। ডিউটির বাইরের ঘন্টাগুলো টেলিস্কোপে চোখ রেখে কেটে যায়। অথবা উৎসুক কথোপকথনের ফোয়ারা ছোটায় কুরা। কেউ কেউ মিউজিক শুনে সময় কাটায়। কিন্তু সবার স্থির দৃষ্টি বাইরের অভূতপূর্ব দৃশ্যে। অন্তত শিপে ঠাট্টা চালানোর একটা উপায় পাওয়া গেল, সবাই যখন অবাক চোখে বৃহস্পতির দিকে তাকিয়ে তখন ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কি আর জেনিয়া মার্শেঙ্কো হঠাৎ হাওয়া হয়ে যায় সবার মাঝ থেকে। এজন্য হাল্কা হাসিঠাট্টাও হয়। বেচারারা এত ছোট শিপে নিজেদের মতো করে মিশতে পারে না।
ফ্লয়েড ভাবল, কী অদ্ভুত জুটি! সুদর্শন ম্যাক্স লম্বা, চওড়া, স্বর্ণাভ চুলের অধিকারী একজন চ্যাম্পিয়ন ব্যায়ামবীর। ও দুহাজারের অলিম্পিক ফাইনালে গিয়েছিল। বয়স ত্রিশে পড়লেও ভাবভঙ্গি বাচ্চা ছেলের মতো। এই সব না; উজ্জ্বল ইঞ্জিনিয়ারিং রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও সে প্রায়ই ফ্লয়েডকে নিজের লোকের মতো অস্বাভাবিকভাবে আঘাত করে তেমন আপন লোকের মতো যারা কথা বলার ক্ষেত্রে আমুদে, কিন্তু বেশি সময়ের জন্য নয়। নিজের সর্বস্বীকৃত পটুতার ক্ষেত্রের বাইরেও সে ব্যস্ত থাকে, কিন্তু গভীরভাবে নয়।
ঊনত্রিশ বছরের জেনিয়া শিপের সবচে কমবয়েসী কু। এখনো রহস্যময়। কেউ তার দুর্বলতার কথা তোলার আগ পর্যন্ত ফ্লয়েড কখনো প্রসঙ্গটা তোলে না। ফ্লয়েডের ওয়াশিংটনের সোর্স তাকে এ নিয়ে কিছু জানাতে পারেনি। বোঝাই যায় সে কোনো ভয়ংকর দুর্ঘটনায় পড়েছিল। গাড়ির দুর্ঘটনাই হবে। এরচে অস্বাভাবিক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম। সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে জনপ্রিয় লোকগাঁথার এটা একটা অংশ যে সে এক গোপন স্পেস মিশনে ছিল। এ আশা বাদ দেয়া যায়। গ্লোবাল ট্র্যাকিং নেটওয়ার্ককে ধন্যবাদ, এ ধরনের ঘটনা অর্ধশতাব্দী যাবৎ অসম্ভব। জি টি এন তা ধরবেই। প্রকট শারীরিক ও মানসিক ক্ষত থাকা সত্ত্বেও জেনিয়া খেলেছে আরো কয়েকটা খেলা। সে শেষ মুহূর্তের প্রতিস্থাপিত যাত্রী-সবাই জানে।
ইরিনা ইউকোনিনার খাদ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ এবং মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়ার কথা। কিন্তু চলে এল সে। একটা হ্যাং গ্লাইডার ইউকোনিনার অনেকগুলো হাড় ভেঙে দেয়।
প্রতিদিন জিএমটি৬৭ আঠারোতম ঘণ্টায় সাতজন ক্রু এবং একজন যাত্রী ছোট্ট কমনরুমে একত্র হত। কমনরুমটাই গ্যালি ও স্লিপিং কোয়র্টারগুলোকে ফ্লাইট ডেক থেকে আলাদা করে। বৃত্তাকার টেবিলটা আটজনের গাদাগাদি করে বসার জন্য যথেষ্ট। চন্দ্র আর কার্নো জেগে উঠলে প্রত্যেককে এখানে জায়গা দেয়াটা হবে সমস্যা। অন্য কোথাও বসানো হতে পারে দু সিট।
সিক্স ও ক্লক সোভিয়েত নাম দেয়া হয়েছে এর। প্রতিদিনের গোল টেবিল কনফারেন্স বলা হয় অনুষ্ঠানটাকে। সাধারণত দশ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না। শিপের নিয়ম, কমান্ড আর মানবিকতা বজায় রাখতে বিরাট ভূমিকা রাখে। অভিযোগ, পরামর্শ, সমালোচনা এবং উন্নয়ন প্রতিবেদনের সবই উত্থাপিত হতে পারে ক্যাপ্টেন যদি ভেটো না দেয়। ভেটোর মতো বাজে জিনিসের চর্চা হয় খুবই কম।
আজকের মেনুতে একটা পরিবর্তন আনার আবেদন করা হয়েছে। টেবিলে আলোচ্য বিষয়ের বাইরে জটিল ব্যাপারগুলো আলোচনার জন্যই এ আবেদন। পৃথিবীর সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগের জন্য আরো সময় দেয়ার প্রস্তাব উঠেছে। মহাকাশে ছড়িয়ে আছে প্রচুর আমেরিকান সৈন্যদল। সৈনিকদের সাথে চলচ্চিত্র প্রোগ্রাম, সংবাদ আদান-প্রদান আর গল্পগুজব করার ব্যাপারেও কথা ওঠে।