…ভেজা সমুদ্রশৈবালের চুলের মতো হামাগুড়ি দিচ্ছিল বরফের উপর। লি ক্যামেরা আনার জন্যে জাহাজের পেছনে যায়-আমি লক্ষ্য করছি, একই সাথে রিপোর্ট করছি রেডিওতে। জিনিসটা এত আস্তে আস্তে চলছিল যে আমি দৌড়ে একে ছাড়িয়ে যেতে পারতাম সহজে। সতর্ক হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি উত্তেজিত ছিলাম। ভাবলাম এটা কী ধরনের প্রাণী আমি জানি। ক্যালিফোর্নিয়ার কাছাকাছি বড়
সামুদ্রিক গুল্ম বনের ছবি আমার দেখা কিন্তু আমার খুব বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল।
… প্রাণীটার কোনো না কোনো সমস্যা ছিল, আমি শিওর। এর সাধারণ পারিপার্শ্বিক অবস্থার চেয়ে একশ পঞ্চাশ ডিগ্রী কম তাপমাত্রায় বেঁচে থাকা অসম্ভব। সামনে আসার সময় জমে কঠিন হয়ে গিয়েছিল-ছোট ছোট টুকরো আলাদা হয়ে যাচ্ছিল কাঁচের মতো কিন্তু তখনো জাহাজের দিকে এগুচ্ছেই। কালো সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সব সময়ই মন্থর মনে হয়।
আমি তখনো এত বিস্মিত যে সোজাসুজি চিন্তা করতে পারিনি। কল্পনাই করতে পারিনি এটা কী করার চেষ্টা করছে…।
ফ্লয়েড মরিয়া হয়ে ফিসফিস করে ওঠে, তার ডাকে সাড়া দেয়ার কোনো পথই কি নেই?
না-দেরি হয়ে গেছে অনেক। ইউরোপা একটু পরেই বৃহস্পতির পেছনে চলে যাবে। গ্রহণের বাইরে আসা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। লিওনভ কন্ট্রোল জবাব দেয়।
এদিকে বলে চলেছে প্রফেসর চ্যাং, … জাহাজের উপর উঠে এগিয়ে যাবার সাথে সাথে তৈরি করে বরফের এক সুড়ঙ্গ। সম্ভবত জিয়াংয়ের উষ্ণতা দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চায়-মাটির ছোট্ট করিডোরে উইপোকা যেমন আটকা পড়ে যায়, তেমন করে শিপও এর ঘোরটোপে পড়ে গেল।
…জাহাজের উপর টনকে টন বরফ জমেছে। রেডিও অ্যান্টেনা বন্ধ হয়ে গেছে প্রথমবারের মতো। তারপর দেখতে পেলাম নামতে থাকা পাগুলো সব কুঁচকে যেতে শুরু করে; দুঃস্বপ্নের মতো ধীর গতিতে।
শিপ নড়বড় হয়ে পড়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমি বুঝতেই পারিনি জিনিসটা কী করার চেষ্টা করছে-তখন আর সময় নেই। ঐ লাইটগুলো বন্ধ করে দিলেই নিজেদের আমরা রক্ষা করতে পারতাম।
সম্ভবত প্রাণীটা আলোতে সক্রিয় হয়, এবং বায়োলজিক্যাল আবর্তনে সূর্যের আলো পড়লে হয়ত এ অদ্ভুত জিনিসটা হিংস্র হয়ে পড়ে। সেই আলো বরফের মধ্য দিয়ে বিশোধিত হয়ে প্রবেশ করে ভিতরের জগতে। আলোর প্রতি পতঙ্গের মতো আকৃষ্ট হতে পারে এটা। আমাদের ফ্লাডলাইট অবশ্যই ইউরোপা এ পর্যন্ত যা দেখেছে তার চেয়ে অনেক অনেক উজ্জ্বল…
তারপর ভেঙে গেল শিপ। আমি নিজের চোখে জাহাজের কাঠামো লম্বালম্বিভাবে টুকরা হতে দেখলাম। তুষার ফলকের এক মেঘ ঘন ঘন আর্দ্র করে তোলে চারপাশকে। দুমিটার উপরে ক্যাবলে ঝুলছিল একটা বাতি। বাকি সবগুলো নিভে গেল সামনে পেছনে দুলতে দুলতে।
জানি না কী হল এর পর। আমার আর কী করণীয়? জাহাজের ধ্বংসস্তূপের পাশে লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। সূক্ষ্ম ফ্রেশ বরফের পাউডারে আমি আবদ্ধ। এর মধ্যে আমার জুতার ছাপ খুব স্পষ্ট দেখতে পেলাম। অবশ্যই সেখানে হেঁটেছি সম্ভবত মাত্র এক বা দুমিনিট পর। হিতাহিত জ্ঞান ছিল
চারাগাছটা-আমি এখনো এটাকে ঝাকড়া চারাগাছ হিসেবে ভাবি! জিনিসটা ছিল স্থির। অবাক চোখে দেখি এটা ধ্বংস হচ্ছে আঘাতে আঘাতে, বড় বড় কাটা অংশ মানুষের হাতের মতো ঘন টুকরো টুকরো হয়ে শাখা প্রশাখার মতো ছিটকে পড়ল।
তারপর আবার চলতে শুরু করে প্রধান কাণ্ডটা। স্পেসশিপের কাঠামো থেকে নিজেকে টেনে বের করে আমার দিকে হামাগুড়ি দিতে শুরু করলে আমি নিশ্চিতভাবে জানলাম যে সেটা আলোতে প্রতিক্রিয়াশীল। দাঁড়িয়ে ছিলাম হাজার ওয়াট বাতির ঠিক নিচে। জিনিসটা এখন বন্ধ করেছে নিজেকে দোলানো।
একটা ওক গাছের সাথে এর মিল এখনো দেখতে পাই যেন, কোনো বটগাছ বহুশাখা এবং মূল নিয়ে মাধ্যাকর্ষণে চিড়েচ্যাপ্টা হলে যেমন দেখায় তেমন। বরফ। ঘেঁষে চুপিসারে চলতে চেষ্টা করছিল জিনিসটা। আলোর পাঁচ মিটারের মধ্যে পৌঁছে আমার চারদিকে এক নিখুঁত বৃত্ত তৈরি করে নিজেকে ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। বোঝাই যায় সে এলাকাই ওটার সহ্যক্ষমতার সীমা-আরো সামনে তার আলোক আকর্ষণ হয়ত অরুচিকর। তারপর কয়েক মিনিটের জন্যে কিছুই হয়নি, আমি বরং ভাবছি মরে জমে কঠিন হয়ে গেল কিনা।
তারপর দেখলাম বিরাট বিরাট মুকুল গঠিত হতে শুরু করেছে অনেক শাখা প্রশাখা সহ। অনেকক্ষণ। ফুল ফুটতে দেখার মতো ধৈর্য নিয়ে বসে থাকতে হল আমাকে। আসলে ভাবছিলাম আকৃতির কথা। এক একটা ফুল মানুষের মাথার মতো বড়! কোমল, সুন্দরভাবে রঙিন ঝিল্লি ভাজ ভাঙ্গতে শুরু করে। এমনকি তখনও মনে হল যে, কোনো মানুষ বা প্রাণী এর আগে এমন রঙ কক্ষনো দেখেনি। এত রঙের অস্তিত্বই থাকত না যদি আমাদের লাইট-আমাদের প্রাণনাশক লাইট এ দুনিয়ায় বয়ে না আনতাম।
চারদিকে আস্তে আস্তে দুলছে পুংকেশর… জীবন্ত দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটলাম যাতে ব্যাপারটা ঠিকমতো দেখতে পারি। আমি ঐ প্রাণীকে সামান্যতম ভয় পাইনি কখনোই। শিওর ছিলাম, এটা পরশ্রীকাতর না-যদি তাই হয়ে থাকে তবে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করত। ও আমার অস্তিত্ব টের পায় ভালভাবেই।
বড় ফুলগুলোর স্তরে স্তরে ভাজ ভাঙার খাজ। এবার এরা মনে করিয়ে দেয় প্রজাপতির কথা, যা এইমাত্র পুঁয়োপোকার আবরণ থেকে বেরুল-ডানায় ভাঁজ-ভাঁজ চিহ্ন, এখনো ক্ষীণ-আমি ক্রমেই সত্যের কাছাকাছি যাচ্ছিলাম।