কিন্তু এক মিনিটও দেরি না করে লিওনভের সরাসরি সংবাদ সংগ্রহের সামর্থ থাকা উচিত। সুতরাং চীনাদের সম্প্রচারে ফিরে আসার মতো যথেষ্ট সময় হাতে আছে এখনো। লিওনভের অবিরাম প্রচারের পরও নীরবতার ফলে কোনো না কোনো বিপর্যয়ের সম্ভাবনা উঠে আসে। এমনকি সে নিজেকে ঐ অসীম দৃশ্য গঠন করতে দেখতে পেল।
এ পঞ্চাশ মিনিটকে মনে হয় কয়েক ঘণ্টার মতো। উপরে থাকার সময় শাসা অ্যান্টেনা কমপ্লেক্সকে পেছনে পৃথিবীর দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। সে একই সাথে দিল ব্যর্থতার খবর। দশ মিনিটের বাকি সময় ব্যবহার করে পৃথিবীতে পেছনের দীর্ঘ খবর পাঠানোর সময় প্রশ্নের দৃষ্টিতে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকায়, আবার চেষ্টা করা কি ঠিক হচ্ছে?
অবশ্যই। আমরা পৃথিবীতে খোঁজ খবরের সময় কমাতে পারি কিন্তু জিয়াংকে শোনার সময় ঠিক রাখব।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বড় ডিশ আরো একবার ইউরোপার দিকে তাক করার সাথে সাথে অটোমেটিক মনিটরের ইমার্জেন্সি লাইট শুরু করে ফ্লাশ।
শাসার হাত দ্রুতবেগে কাজ করছে অডিও পাওয়ার আশায়। বৃহস্পতির শব্দ কেবিনকে ভরে দেয় আবারো। বজ্রঝড়ের বিরুদ্ধে ফিসফিস করে বলা শব্দের মতো শোনা গেল একটা কিছু। অস্পষ্ট, কিন্তু পুরোপুরি মানুষের কথা। ভাষা চেনাটা অসম্ভব হলেও ফ্লয়েড স্বরভেদ এবং ছন্দ শুনে বুঝেছে চাইনিজ নয়। ইউরোপিয়ান কোনো ভাষা হতে পারে।
শাসা ফাইন-টিউনিং এবং ব্যান্ড-উইডথ কন্ট্রোলের সাথে দক্ষভাবে খেলার পর তাতে শব্দগুলো একটু পরিষ্কার হয়। আচ্ছা! নিঃসন্দেহে ইংরেজি কিন্তু এখনো কথাগুলো বোঝাই যায় না। বিরক্তিকর।
শব্দগুলোর একটা সংযুক্তি আছে, সব মানুষের কান সাথে সাথে চিনতে পারবে। এমনকি সবচে গোলমেলে পরিবেশেও।
শব্দটা হঠাৎ করে বৃহস্পতির পটভূমি থেকে উঠে এলে ফ্লয়েডের মনে হল যেন চোখ খুলেও সে ঘুম থেকে জাগেনি। আটকা পড়েছে কিছু অদ্ভুত স্বপ্নের ফাঁদে। তার সহকর্মীরা সাড়া দিতে একটু দেরি করে ফেলে; তারপর তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকায় একইভাবে, বড় বড় চোখ করে। তারপর ধীরে ধীরে যেন কথাগুলো সাজিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে নিজের ভিতর।
ইউরোপা থেকে প্রথমবারের মতো স্বীকারযোগ্য শব্দগুলো কাঁপিয়ে দেয় সবাইকে, ডক্টর ফ্লয়েড-আশা করি শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা। কারণ এরচে বেশি কিছু আর আশা করার নেই।
১১. শূন্যতায় জমাট জল
হুশ শব্দে কেউ একজন ফিসফিস করে প্রশ্ন ছোঁড়ে ফ্লয়েডের দিকে- কে? ফ্লয়েড হাত তুলে না জানার ইশারা করে-মনেপ্রাণে চায় যেন তার পরিচিত না হয় নোকটা। হলেই তা আরো কষ্ট বয়ে আনবে।
.. জানি আপনি লিওনভে… বেশি সময় নেই হয়তো… আমার স্যুট অ্যান্টেনা দেখে মনে হয়…
একটা বিরক্তিকর সেকেন্ডের জন্য সংকেত হাওয়া হয়ে গেল, তারপর ফিরে এল অনেক পরিষ্কারভাবে। খুব উঁচু শব্দ নয়।
…প্লিজ এ তথ্য পৃথিবীতে রিলে করবেন। জিয়াং তিন ঘন্টা আগে ধ্বংস হয়ে গেছে। একমাত্র আমিই জীবিত। আমার স্যুট রেডিও ব্যবহার করছি-জানি না এটার যথেষ্ট রেঞ্জ আছে কি না কিন্তু এটাই একমাত্র সুযোগ। প্লিজ, মনোযোগ দিয়ে শুনুন। ইউরোপায় জীবন আছে। আমি আবার বলি, ইউরোপার জীবনের অস্তিত্ব আছে…
সংকেতটা আবার বিলীন হয়ে যায় ধীরে ধীরে। এক অচেনা নীরবতা অনুসরণ করে বোঝা গেল কেউ বাধা দেয়ার চেষ্টা করেনি। অপেক্ষা করার সময় ফ্লয়েড পাগলের মতো হাতড়ে বেড়ায় তার স্মৃতির লুকানো কুঠুরিগুলো। চিনতে পারে
-পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত চীনের যে কোনো লোক হতে পারে। হয়ত সায়েন্টিফিক কনফারেন্সে তার দেখা পেয়েছে এমন কেউ। যে পর্যন্ত বক্তা নিজের পরিচয় নিজে না দেবে, সে কখনো চিনবে না।
…স্থানীয় মধ্যরাতের ঠিক পরে। আমরা নিয়মিত পাম্পিং করছিলাম। প্রায় অর্ধেক ভরে গেছে ট্যাংকগুলো। ডক্টর লি আর আমি পাইপ ইনসুলেশন চেক করার জন্যে বাইরে গিয়েছিলাম। জিয়াং দাঁড়িয়ে আছে-দাঁড়িয়ে ছিল-গ্র্যান্ড ক্যানেলের সীমানার প্রায় ত্রিশ মিটার দূরে। পাইপগুলো সরাসরি এখান থেকে নেমে নিচের বরফের মধ্যে ঢোকে। বরফ আবার খুব পাতলা-হাঁটার মতো নিরাপদ নয়। পাইপের পানি অবশ্য গরম…
…কোনো ব্যাপার না-পাঁচ কিলোওয়াট আলো জ্বালিয়ে জাহাজের উপর টানালাম। ক্রিস্টমাস ট্রির মতো সুন্দর চককে আলো ঠিক বরফের মধ্যদিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছিল নিচের পানিতে। চমৎকার রঙ। লি-ই প্রথম দেখে-এক বিশাল কালো পিণ্ড গভীর থেকে উঠছে উপরের দিকে। প্রথম প্রথম আমরা মনে করেছিলাম মাছের বিরাট কোনো ঝাক হবে-একক প্রাণিসত্তার হিসেবে খুব বড় তো-তারপর জিনিসটা এগিয়ে এল বরফের ভিতরে দিয়ে জোর করে পথ বানিয়ে নিয়ে।
ডক্টর ফ্লয়েড, আশা করি আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন। আমি প্রফেসর চ্যাং-আমরা মিট করেছিলাম দু হাজার দু সালে, বোস্টন আই. এ. ইউ. কনফারেন্সে।
সাথে সাথে ফ্লয়েডের ভাবনা চলে গেল শত কোটি কিলোমিটার দূরে। সে ভাসাভাসা মনে করতে পারে ঐ রিসিপশনের কথা। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন কংগ্রেস এর সমাপনী সেশনের পর-সবার শেষ ব্যক্তি ঐ চীনদেশি। দ্বিতীয় কালচারাল রেভুলশনেও ছিল। আস্তে আস্তে সে চ্যাংকে খুব ভালভাবে মনে করতে পারল-একজন ছোটখাট বায়োলজিস্ট যার কৌতুকের ভাণ্ডার খুব সমৃদ্ধ। সে এখন আর কৌতুক করছে না।