দক্তর ফ্লয়েদ, দক্তর ফ্লয়েদ-ঘুম থেকে ওঠো, প্লিজ! ফ্লাইট ডেকে তোমার ডাক পড়েছে?
এবং কেউই তাকে ডক্টর ফ্লয়েড বলে ডাকে না, সবচে বেশি আনুষ্ঠানিক অভিবাদন সে গ্রহণ করেছিল ডক্টর চন্দ্রের কাছ থেকে। হচ্ছেটা কী?
বিরক্তি নিয়ে সে চোখ খুলল। নাহ, সে তো ছোট কেবিনেই আছে। স্লিপিং কোকুন আঁকড়ে রেখেছে মৃদুভাবে। সুতরাং… মনের একটা অংশ তাকে বলে: কেন সে ইউরোপার দিকে… তাকাচ্ছে? চোখ খুলে জেগে ফ্লয়েড কীভাবে সরাসরি উপগ্রহটার দিকে তাকিয়ে আছে? তারা তো এখনো মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে!
রেখাগুলো একে অন্যকে ছিঁড়ে ফুড়ে বানিয়েছে অদ্ভুত ধূসর পরিবেশ। ত্রিভুজ আর বহুভূজ দিয়ে বানানো নকশার পরিচিত জালি চারপাশে আর অবশ্যই বড় রেখাটা এ্যাও ক্যানেল। না… ঠিক না। তা কীভাবে হতে পারে? সে তো শুয়ে আছে লিওনভের ছোট্ট কেবিনে।
দক্টর ফ্লয়েদ!
এবার সে পুরোপুরি জেগে গেল, এবং বুঝতে পারল যে বাম হাত ভাসছে চোখের ঠিক কয়েক সেন্টিমিটার সামনে। কী অদ্ভুত! রেখাগুলোর নকশা হাতের তালুতে এমন রহস্যময় লেগেছে যেন তা ইউরোপার মানচিত্র! কিন্তু হিসেবী প্রকৃতি এমন বিচিত্র পথে বিশালভাবে বিভিন্ন স্তরে নিজেকে সব সময় দেখায়। প্রকৃতি! যেমন দুধের ঘূর্ণি কফির সাথে মিশে যায়-তীব্র ঝড়ো আবহাওয়ার মেঘের রাস্তাও একইভাবে মেশে। আবার পেঁচানো নীহারিকার হাতগুলোও মিশে যাচ্ছে সেই কফির মতোই।
ম্যাক্স, স্যরি। সে বলল, সমস্যাটা কী? কিছু হয়েছে?
আমরা তা-ই ভাবছি-কিন্তু আমাদের সমস্যা নেই। জিয়াং পড়েছে বিপদে।
ক্যাপ্টেন, নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলী ফ্লাইট ডেকে তাদের সিটে সিটবেল্টে বাধা। বাকি কুরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চারদিকের সুবিধাজনক হ্যাণ্ডহোল্ড ধরে ঘুরছে, ভাসছে অথবা মনিটর দেখছে।
স্যরি, হেউড। তোমাকে ঘুম থেকে জাগাতে হল। তানিয়ার দুঃখ প্রকাশ কী রূঢ়! পরিস্থিতিই এমন। দশ মিনিট আগে আমরা মিশন কন্ট্রোল থেকে প্রথম শ্রেণীর একটা প্রায়োরিটি পেলাম। জিয়াং বন্ধ করে দিয়েছে সম্প্রচার। একদম হঠাৎ করে সাইফার মেসেজের মাঝখানেই ব্যাপারটা হল; কয়েক সেকেন্ডের জন্যে বিকৃত প্রতিবেদন প্রেরণ-তারপর কিছুই নেই।
তাদের বিকন?
এখন সেটাও বন্ধ। অথচ বিকন সব সময় ব্লিপ ব্লিপ করে পৃথিবীর দিকে শিপের ভাল থাকার খবর জানায়। এটাও রিসিভ করতে পারিনি।
উহ্! তা হলে তো মারাত্মক ব্যাপার-বড় রকমের কোনো বিপদ। কোনো না। কোনো ইশারা পাবার কথা, নাকি?
ডাটা আছে প্রচুর কিন্তু সব অনুমানের উপর ভিত্তি করে। বিস্ফোরণ-ভূমিধ্বস ভূমিকম্প…কে জানে?
এবং আমরা কখনো জানতে নাও পারি। জানতে হলে কারো না কারো ইউরোপায় নামতে হবে। অন্তত উড়ে যেতে হবে খুব কাছ থেকে।
তানিয়া তার মাথা ঝাঁকুনি দিল, আমাদের যথেষ্ট ডেল্টা-ভি নেই। সবচে বেশি নৈকট্য পেতে পারি পঞ্চাশ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে। ঐ দূরত্ব থেকে তুমি খুব ভাল দেখতে পাবে না।
তারপর আমাদের করার কিছুই থাকবে না। একেবারেই নয়, হেউড। মিশন কন্ট্রোলের একটা পরামর্শ দেখতে পার। তারা চায়, আমাদের বিগ ডিশ যেন চারদিকে ঘোরাই। স্রেফ ঘটনাক্রমে যেকোনো দুর্বল প্রয়োজনীয় ট্রান্সমিশন পেয়ে যেতে পারি। তোমার মতে আইডিয়াটা কেমন? বহু দূর থেকে নেয়া শট, কিন্তু বাঘের কাছে যাওয়া যায় না। এই সঠিক প্রচেষ্টা। কী মনে হয়?
ফ্লয়েডের প্রথম প্রতিক্রিয়া পুরোপুরি না বোধক, তার মানে পৃথিবীর সাথে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ।
অবশ্যই, কিন্তু যখন বৃহস্পতির আশপাশে যাবো আমাদের তা তো করতেই হবে। সার্কিট ঠিক করতে কয়েক মিনিট সময় নেবে মাত্র।
ফ্লয়েড কথা বলল না। সাজেশনটা আসলেই যুক্তিসঙ্গত, তবু একটু ভয় পাইয়ে দেয়। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হবার পর হঠাৎ করে বুঝতে পারে কেন সে অ্যান্টেনা ঘোরানোর সিদ্ধান্তের বিরদ্ধে যাচ্ছে বারবার।
ডিসকভারির গোলমাল আরম্ভ হয় যখন বিগ ডিশ… সেই প্রধান অ্যান্টেনা কমপ্লেক্স পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, এখনও সেসবের কোনো ব্যখ্যা নেই। অবশ্যই জড়িত ছিল হাল। তবু এখানে দেখা দেয়া একই পরিস্থিতিতে কোনো বিপদ নেই। লিওনভের কম্পিউটারগুলো ছোট ছোট এবং অটোনোমাস ইউনিট; আলাদা আর স্বাধীন। একক নিয়ন্ত্রণ মেধা বা বুদ্ধিমত্তা নেই। অন্তত, অমানবীয় কিছু নেই।
রাশিয়ানরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে তার উত্তরের জন্যে।
আমি রাজি, অবশেষে সে বলল, আগে পৃথিবীকে জানতে দাও আমরা কী করি; তারপর শুনতে আরম্ভ কর। আশা করি তোমরা সব স্পেস মে ডে ফ্রিকোয়েন্সির চেষ্টা করবে।
হ্যাঁ, ডপলার সংশোধনের কাজ শেষ করার সাথে সাথে। শাসা, কেমন হবে ব্যাপারটা?
আমাকে আরো দুমিনিট সময় দাও, অটোমেটিক অনুসন্ধান চালাতে পারবো। আমাদের শুনতে হবে কতক্ষণ?
ক্যাপ্টেন তার উত্তর দিতে গিয়ে নামমাত্র থামল। ফ্লয়েড প্রায়ই তানিয়া অর্লোভার সুস্পষ্টতার প্রশংসা করে। আরেকবার তাই বলল তাকে। মেয়েটা সহজে রসিকতা করে না। হঠাৎ চমকে দিয়ে সে বলল, উডি, একজন কমান্ডার ভুল করতে পারে কিন্তু কখনো অনিশ্চিত হয়ে পড়ে না। শোনো পঞ্চাশ মিনিট, পৃথিবীতে প্রতিবেদন দাও দশ মিনিট। চালিয়ে যাও এভাবেই।
দেখা-শোনার কিছুই নেই। মানুষের নার্ভাস সিস্টেম অসম্ভব গতিময়, তীক্ষ্ণ আর সূক্ষ্ম। মানুষের ইন্দ্রিয়ের চেয়েও ভাল কাজ করে অটোম্যাটিক সার্কিট। বেতার শব্দ ট্রান্সমিশনে এটা একেবারে এক্সপার্ট। তবু সময়ে সময়ে শাসা অডিও মনিটরে গিয়ে বসে থাকে। প্রতিবারই কেবিনকে ভরে তোলে বৃহস্পতির তেজস্ক্রিয় এলাকার গর্জন। পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্র সৈকতের ঢেউ ভাঙ্গার শব্দের মতো। মাঝেমধ্যে বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে বিজলি চমকের সাথে অসীম বজ্রপাত হয়। বিস্ফোরকের হঠাৎ তীক্ষ্ণ কোনো শব্দ নেই। একের পর এক সংকেত দূরে গিয়ে ভাসে; জবাব নেই। অপেক্ষা করার সময় ফ্লয়েড মনে মনে কিছু হিসাব করছে। জিয়াংয়ে যাই ঘটে থাক; পৃথিবীতে এর খবর পাঠানো শেষ হয়েছে দুঘণ্টারও আগে।