উপরের অংশ গোলাপী, সমতল। তার মধ্যে কলঙ্কের মতো কয়েকটা ছোট বাদামি দাগ। সুতায় বোনা জালের মতো, কোঁকড়ানো আর সব দিকে যেন বুনন দিয়ে ঢাকা। আসলে মেডিক্যাল টেক্সটবুকে দেখানো শিরা আর ধমনীর প্যাটার্নের ছবির মতো দেখায় একে। এ সব দাগের কয়েকটা শত শত-বা হাজার হাজার কিলোমিটার লম্বা। দেখতে যেন রহস্যময় খাল। যাকে বলে পারসিভাল লোয়েলের নালা। বিশ শতকের প্রথম দিকের অন্যান্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কল্পনা করেছিলেন যে তারা দেখেছেন মঙ্গলগ্রহের খাল।
কিন্তু ইউরোপার নালাগুলো মিথ্যা নয়। আরো একটা কথা, এগুলো অবশ্যই প্রাকৃতিক। আর কী, এগুলোয় পানি বইছে। অন্তত বরফ। সেজন্য উপগ্রহটা গড়ে পঞ্চাশ কিলোমিটার গভীর মহাসাগর দিয়ে প্রায় পুরোপুরি ঢাকা। সূর্য থেকে বহু দূরে বলে ইউরোপার পিঠের তাপমাত্রা খুবই কম। হিমাঙ্কের প্রায় একশ পঞ্চাশ ডিগ্রী নিচে। সুতরাং কেউ আশা করতে পার যে এর এক একটা মহাসাগর বরফের একটা শক্ত টুকরো। এমন হতেই পারে।
অবাক করা কথা হলেও ব্যাপার তা নয়। প্রচুর তাপ জনে ইউরোপার ভেতরে। জোয়ারের কারণে প্রতিবেশী আইওর আকর্ষণ এ তাপগলা পানিকে নাড়িয়ে রাখে সারাক্ষণ। আইওর দানব আগ্নেয়গিরির শক্তিও এ পানিকে গলিয়ে রাখে। তাই বরফ গলে, ভাঙে আবার জমেও যায়। ফাটল ধরে সব সময় আমাদের পৃথিবীর স্তরের মতো পথও হয় তৈরি। ফাটলের ঐ জটিল নকশা আমি দেখছি এখন। খাদগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই প্রাচীন, আঁধারে ছাওয়া। সম্ভবত শতকোটি বছরের পুরনো। কিন্তু কয়েকটা প্রায় পুরোপুরি সাদা। এগুলো নতুন। কোনো কোনোটা গড়ে উঠছে ঠিক এ মুহূর্তে। মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার ঘন কঠিন স্তরও আছে কোথাও কোথাও।
জিয়াং নেমেছে তেমনি এক সাদা আঁকাবাঁকা দাগের ডান পাশে-পনেরোশ কিলোমিটার লম্বা সেই খালটা। নাম গ্র্যাণ্ড ক্যানেল। ধরা যায় চৈনিকরা তাদের প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাংকে এখান থেকেই পানি তোলার আশা করে। বৃহস্পতির উপগ্রহ জগৎ খুঁটে দেখতে পাবে তাহলে। শেষে পৃথিবীতেও ফিরে যেতে পারে। বিদঘুঁটে এলাকাটায় সহজে ল্যান্ড করা সম্ভব না। কিন্তু বিধি বাম, তাদের শিপ ল্যান্ড করার মতো করেই বানানো। নিশ্চই যত্নের সাথে ল্যান্ডিং সাইট দেখে নিয়েছে আগেভাগে। কী করতে চলল তাও নিশ্চই তাদের জানা।
কেন তারা ফুয়েল শেষ করার এমন ঝুঁকি নিল তা এখন পরিষ্কার। কেন তারা ইউরোপার দখল দাবী করছে অনেক আগে থেকে তাও বোঝা যায়। এ স্থান বৃহস্পতিতে আসার জন্য যত জরুরি, তারচে বেশি জরুরি সৌর জগতের বাইরে মিশন পরিচালনার জন্য। পৃথিবী থেকে এ পর্যন্ত এলেই সৌর জগতের অনেকটা পেরুনো হয়, এখান থেকে আবার প্রোপ্যাল্যান্ট নিলেই হল, ঘাঁটি গেড়ে বসতেও দোষ নেই। গ্যানিমিডে পানি থাকলেও ওটা পুরোপুরি জ্যাম হয়ে আছে আর সবসময় ঢোকাও যায় না। উপগ্রহের অভিকর্ষ শক্তিও এক সমস্যা।
আরো একটা পয়েন্ট এইমাত্র আমার মনে পড়ল। চৈনিকরা ইউরোপার উপর ভিড়তে পারলেও তাদের জীবন বাঁচানোর মতো সামর্থ্য থাকতে হবে, অন্তত যে পর্যন্ত উদ্ধার অভিযানের ব্যবস্থা না করা যায়। তাদের প্রচুর শক্তি আছে, স্যাটেলাইট এলাকায় প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ থাকতে পারে-এবং আমরা জানি চীনারা কৃত্রিম খাদ্য বানানোয় পারদর্শী। হয়ত খুব বিলাসবহুল জীবন কাটানো হবে না, কিন্তু আমার কিছু কাজপাগলা বন্ধু আছে যারা এ জীবন খুশি মনে গ্রহণ করবে। তারা যে শুধু দেশপ্রেম বা বিজ্ঞানপ্রেম বা ক্যারিয়ারের স্বার্থ অথবা অ্যাডভেঞ্চারের আশায় এই কষ্টকর জীবন মেনে নেবে তা নয়। বরং তারা তাদের পছন্দের কাজই করবে; এ এক নেশা, ভয়ংকর নেশা। বৃহস্পতির বিখ্যাত রহস্য-কুয়াশা ভেদ করতে এলোমেলোভাবে আকাশে ছড়িয়ে পড়ার জন্যে তারা বোধহয় তৈরি। কিছুদিনের মধ্যে আমরা স্বয়ং সে দৃশ্য দেখব বলে আশা করছি।
অ্যালেক্সি লিওনভ থেকে হেউড ফ্লয়েড বিদায় জানাচ্ছি আমার বন্ধুদের।
এবং ব্রিজ থেকে বলছি। দারুণ! সুন্দর উপস্থাপনা, হেউড। তোমার সাংবাদিক হওয়া উচিত ছিল।
আমার অভ্যাস আছেরে ভাই। জীবনের অর্ধেকটাই কেটে গেল পি আর ওয়ার্কে।
পি আর?
পাবলিক রিলেশন-সারা বছর রাজনীতিক আর মিডিয়ার লোকরা প্রশ্ন করত কেন আমাকে প্রজেক্টে বেশি টাকা দেয়া হয়। কেন মহাকাশ সংস্থা বসে বসে খায়, কেন লোক ছাঁটাই করে না…বাপরে! এ নিয়ে তোমার চিন্তায় পড়ার কিছু নেই।
আশা করি সত্যি। যাহোক, ব্রিজে এসো। নতুন কিছু ডাটা আসায় তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে চাচ্ছি আমরা।
ফ্লয়েড মাইক্রোফোনের বোতাম সরালো, জায়গামতো টেলিস্কোপ তালা মেরে দেখার ছোট্ট ধাতব জিনিসটার নাগপাশ থেকে মুক্ত করল নিজেকে। জায়গা ছাড়ার সাথে সাথে একই কাজে বেরুনো নিকোলাই টার্নোভস্কির সাথে প্রায় ধাক্কা খেল।
নিকোলাই সপ্রতিভভাবে বলে ওঠে, তোমার দারুণ বর্ণনাটা রেডিও মস্কোর জন্য চুরি করছিলাম, উডি। আশা করি কিছু মনে করবে না।
ইউ আর ওয়েলকাম, টোভারিশ, যাহোক, আমি কি তোমার চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে পারতাম? কীভাবে?
ব্রিজের উপর ক্যাপ্টেন অর্লোভা শব্দের ঘন তূপের দিকে একবার তাকাচ্ছে, আরেকবার মেইন ডিসপ্লের উপর ফিগারের দিকে। বেচারির মুখটা শুকনো। ফ্লয়েড ব্যাপারগুলোর অর্থ বের করা শুরু করছে। কাজটা বিরক্তিকর। সে তাকে বাধা দিল, বিস্তারিত বর্ণনার জন্যে চিন্তা করো না। জিয়াংয়ে ট্যাংক রিফিল করা এবং উঠে আসার প্রস্তুতি নেবার জন্যে কতটা সময় দরকার শব্দগুলো সেটাই দেখায়।