আমি আরেকটা আন্দাজের ঝুঁকি নিই? দ্রুত সার্ভে করবে এবং তারপর নামবে।
ক্ষেপেছ নাকি? এক মিনিট! তুমি এমন কিছু জানো যা আমরা জানিনা-ঠিক?
না। এ সম্ভাবনাটা সহজেই বাদ দেবার মতো নয়। তুমি নিজের পায়ে কুড়াল মারা শুরু করবে। চালবাজের মতো এখনো বলে চলছে ফ্লয়েড।
ঠিক আছে, শার্লক হোমস! তারা কোন উসিলায় ইউরোপায় নামতে চাইতে পারে? ঈশ্বরের দোহাই, কী আছে সেখানে?
ফ্লয়েড তার বিজয়ের ছোট মুহূর্তটাকে এনজয় করছে। অবশ্যই, সে বসে আছে। এখনো ভুল-সঠিকের মধ্যিখানে।
ইউরোপায় কী আছে? সামান্য জিনিস। জগতের সবচে মূল্যবান পদার্থ।
সে অতিরঞ্জিত করলেও ভ্যাসিলি বোকা নয়। ফ্লয়েডের ঠোঁট থেকে উত্তরটা কেড়ে নিল।
অবশ্যই-পানি!
ঠিক। এবং বিলিয়ন বিলিয়ন টন। প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাংকগুলো ভরার জন্য যথেষ্ট ঐ পানি। জ্বালানি কম খরচ করে সব উপগ্রহের চারদিকে ঘুরে বেড়াও। ডিসকভারির অবস্থান আর নিজের বাড়ির দিকে অভিযানের জন্যে অনেক পথ বাকি। আমি এ কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছি, ভ্যাসিলি-কিন্তু আমাদের চাইনিজ বন্ধুরা চাতুরীতে আবারো আমাদের ছাড়িয়ে গেছে।
সব সময় পার পায়। অবশ্যই, এবারও তারা পার পেয়ে যাবে।
৯. গ্র্যান্ড ক্যানেলের বরফ
চকচকে কালো আকাশ ছাড়া এমন একটা ছবি পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের যে কোনো জায়গায় তোলা যায়; দিগন্তের ছেড়ে যাওয়া সব পথে কুঁচকে যাওয়া বরফের সাগর মোটেই অন্যরকম নয়। শুধু অন্যরকম দৃশ্যটা হল-মহাশূন্য পোশাক পরা পাঁচটা মানব-মূর্তি সামনে থেকে বলছিল যে সামনের দৃশ্যটা আরেক পৃথিবীর।
এখনো চীন আগের পথেই চলে। দরকারি-অদরকারি সব কথাই গোপন রাখে। ক্রুদের নামও প্রকাশ করেনি। ইউরোপার জমে যাওয়া বরফের আবরণের উপর নামহীন অনাহুত প্রবেশকারীর সংখ্যা স্রেফ পাঁচজন। প্রধান বিজ্ঞানী, কমান্ডার, নাবিক, প্রথম প্রকৌশলী, দ্বিতীয় প্রকৌশলী। এ এক রকমের আঘাত, ফ্লয়েড ভাবতে পারছে না যে লিওনভে ঢোকার একঘণ্টা আগে পৃথিবীতে প্রত্যেকে খুব কাছে থেকে ঐ ঐতিহাসিক ছবি দেখেছিল। কিন্তু জিয়াংয়ের ট্রান্সমিশন আলোর এমন সংকেতের মাধ্যমে পাঠানো হয় যে এদের কাজে নাক গলানো অসম্ভব ব্যাপার। লিওনভ শুধু আলোক সংকেত রিসিভ করতে পারে আর সব দিকে প্রচার করে, ব্যস। বুঝতে পারে না কিছুই। এমনকি সেই সংকেতও বেশিরভাগ সময় শোনা যায়নি; ইউরোপার ঘূর্ণন একে দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে গেছে, বা উপগ্রহটা নিজে বৃহস্পতির ভয়ংকর গ্রহণে পড়েছে। চাইনিজ মিশনের সব খবর পেতে হয়েছে পৃথিবী থেকেই।
প্রাথমিক জরিপের পর কিছু কঠিন পাথুরে দ্বীপের একটাতে জাহাজ ভোরের আলোকে ছুঁয়ে দেখল। দ্বীপটা বরফের শক্ত আবরণের বাইরে বেরিয়ে আছে, পুরো চাঁদকে ঘিরে ফেলেছে ঐ কঠিন পানি। বরফ মেরু থেকে মেরুতে সমতল। এ জমাট জলকে খোদাই করার জন্যে কোনো রোদ-বৃষ্টি-ঝড় কিছুই নেই ইউরোপায়। আস্তে আস্তে চলমান পাহাড়ে রূপান্তরের জন্যে স্তরের পর স্তর গড়ার জন্যে স্রোতে বা বাতাসে ভাসমান বরফ নেই। বায়ুশূন্য ইউরোপায় উল্কাপিণ্ড পড়ে থাকতে পারে কিন্তু কখনো বরফের টুকরো নয়। সব উচ্চতাকে কমিয়ে এক স্তরে এনে উপরের অংশকে ছাঁচে ঢালাই করার জন্যে একমাত্র শক্তি হল অভিকর্ষের টান। অন্য উপগ্রহগুলো ইউরোপাকে বারবার পেরিয়ে যাবার কারণে তৈরি বিরামহীন কম্পনও এ বরফ স্তর সমান করার জন্য দায়ী। সবচে বড় কথা, বৃহস্পতির প্রভাবও পড়ে। গ্রহরাজের টানে আসা জোয়ার ফুরিয়েছে অনেক অনেক কাল আগে, আজ এ বরফের রাজ্যে কোনো জোয়ার নেই। ইউরোপা তার দৈত্য প্রভুর দিকে এক মুখ ঘুরিয়ে তালাবদ্ধ হয়ে আছে চিরতরে। যেন বৃহস্পতিই এর রক্ষাকবচ।
এসব জানা যায় উনিশশো সত্তুরের অভিযানে ভ্রমণকারীদের ওড়া থেকে, উনিশো আশির গ্যালিলিও৫৩ জরিপ আর উনিশো নব্বইয়ের কেপলার ল্যান্ডিং থেকে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চীনারা আগের সব মিশনের চেয়ে বেশি শিখেছে, জেনেছে ইউরোপা সম্পর্কে। জ্ঞান তারা তাদের মধ্যেই রাখবে; কেউ অনুতপ্ত হতে পারে এ কাজ করায়, কিন্তু সত্যি কথা হল, খুব কম লোকই এসব ব্যাপার বাইরে প্রচারের অধিকার পায়।
অনেক তীব্রভাবে ব্যাপারটা অস্বীকার করা হত। উপগ্রহ অধিকার করার অধিকার। ইতিহাসে প্রথম বারের মতো একটা জাতি অন্য এক পৃথিবীর কাছে দাবী পেশ করেছে, এবং পৃথিবীর সব সংবাদ মাধ্যম আইনি অবস্থানে থেকেই ভিন্নমত জানিয়েছে। পুরো ব্যাপারটা বিরক্তিকর। শেষে চাইনিজরা মুখের উপর বলে দিল যে তারা কখনো ০২ ইউ এন মহাশূন্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। তাই জাতিসংঘের শর্ত মানতেও বাধ্য নয়। সবাই রেগে গিয়ে প্রতিবাদ করলেও তারা থেকেছে নিজের মতো। আসলে ইউরোপাকে চাইনিজ কলোনি বানানোর প্যানপ্যানানির পেছনের অন্য উদ্দেশ্যটা কেউ আঁচও করতে পারেনি।
হঠাৎ ইউরোপা সৌর জগতের সবচে বড় খবর হয়ে দাঁড়ালো। মনে হয় স্পটে উপস্থিত মানুষের বিরাট চাহিদা আছে।
.
বৃহস্পতির পথে এলেক্সি লিওনভ থেকে বলছি কসমোনট হেউড ফ্লয়েড। তোমরা বেশ কল্পনা করতে পার, পার গুজব তুলতে-তাই আমাদের সব চিন্তা ভাবনা এ মুহূর্তে ঝুঁকে পড়েছে ইউরোপার উপর।
ঠিক এখন আমি এর দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চোখে জাহাজের সবচে শক্তিশালী টেলিস্কোপ। তোমরা খালি চোখে চাঁদকে যেমন দেখো তারচে দশগুণ বড় দেখাচ্ছে বরফ-রাজ্যকে। আসলেই, বড় রহস্যময় দৃশ্য।