ক্যারোলিন ফ্লয়েড স্পিকারের সুইচ বন্ধ করার সাথে সাথে ডলফিনগুলো পুলের নিচে গিয়ে মসৃণ গতিতে ভেসে গেল প্রশান্ত মহাসাগরে; রেখে গেল পানির উপর শুধু মৃদু কয়েকটা ঢেউ। বন্ধুদের চলে যাওয়া বুঝতে পেরে ক্রিস্টোফার কান্না শুরু করেছে। মা তাকে হাতে তুলে চেষ্টা করছে শান্ত করার, কিন্তু কাজ হতে তার অনেকক্ষণ লাগবে।
৮. বৃহস্পতির পথে
অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি বৃহস্পতির। গায়ে তুষার রঙা মেঘের ফিতার সাথে স্যামন মাছের গোলাপী কমলা রঙের বিচিত্র মিশেল। বিখ্যাত গ্রেট রেড স্পট বা বিরাট লাল দাগটা ফ্লাইট ডেক প্রজেকশন স্ক্রিনে চেয়ে আছে হিংস্র চোখের মতো। তিন চতুর্থাংশ আলোয় ভরা। কিন্তু কেউ তাকাচ্ছে না আলোকিত চাকতির দিকে। সব চোখ সেঁটে আছে গ্রহরাজের কিনারায়, চিকণ চাঁদের মতো দেখতে অন্ধকারের উপর। গ্রহের রাতের অংশের উপর দিকে চৈনিক স্পেসশিপটা সেই বিখ্যাত সঙ্কটের মুখোমুখি। জিয়াং বাঁচলে লিওনভও আশা পাবে। তারাও আশা করতে পারবে যে বৃহস্পতির পাশ কাটিয়ে গতি কমিয়ে ঐপাশে যাওয়া সম্ভব।
ফ্লয়েড ভাবল-এত আগ্রহ নিয়ে তাকানোর মানেই নেই। চল্লিশ মিলিয়ন কিলোমিটারের মধ্যে আমরা সম্ভবত কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তাতে কী, যা জানতে চাই রেডিও আমাদের বলবে।
দুঘন্টা আগে জিয়াং সব ভয়েস, ভিডিও এবং ডাটা সার্কিট বন্ধ করেছে। লংরেঞ্জ অ্যান্টেনাগুলো তাপ ফলকের প্রটেকটিভ শেডের ভেতর তুলে নিলেই সব ট্রান্সমিশন বন্ধ হয়ে যায়। শুধু সবদিকে অপারেট করা আলো-সংকেত চাইনিজ শিপের দিকে ট্রান্সমিট করা হচ্ছে এখনো। শিপটা ঐ মহাদেশের সমান মেঘ-মহাসাগরে মগ্ন। লিওনভের কন্ট্রোল রুমে কর্কশ বিপ… বিপ… বিপই এখন একমাত্র শব্দ। ঐ স্পন্দনের প্রতিটা দু মিনিটেরও আগে বৃহস্পতির এলাকা ছেড়েছে; তার মানে লিওনভ নজর রাখছে দু মিনিটের পুরনো পরিস্থিতির উপর। এরই মধ্যে এ বিপ গুলোর উৎসটা হয়ত বৃহস্পতির আকাশে বিস্ফোরিত হয়ে ভাস্বর গ্যাসের সাথে সাথে জ্বলছে। কে জানে!
সংকেত ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। জোরালো শব্দগুলো হচ্ছে বিকৃত। কয়েকটা শব্দ পুরোপুরি হাওয়া হয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে ধারাবাহিকতা। জিয়াংকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে একটা রক্তিম আবরণ, শিপটা বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবে মনে হয়। যদি করে থাকে…
ম্যাক্স চিৎকার করে ডাকল, পসমত্রি! ওখানে ওটা!
ফ্লয়েড কিছুই দেখেনি প্রথমে। পরে আলোকিত বৃহস্পতি চাকতির কিনারায় একটু পরেই সে পুঁচকে একটা জ্বলজ্বলে তারা আবিষ্কার করল। বৃহস্পতির আঁধার মুখে কোনো তারা থাকার কথা না। তারাটা একেবারে স্থির। সে জানে এটার অবশ্যই সেকেন্ডে একশ কিলোমিটার বেগে চলাফেরা করছে। আস্তে আস্তে বাড়ছে ঔজ্জ্বল্য। বেশিক্ষণ মাত্রাবিহীন বিন্দুর মতো না থেকে জিনিসটা বড় হতে লাগল। মানুষের বানানো একটা ধূমকেতু বৃহস্পতির রাতের আকাশের ভেতর দিয়ে বিদ্যুতের মতো দ্রুতগতিতে ছুটেছে হাজার হাজার কিলোমিটার লম্বা উজ্জ্বল রেখা পেছনে ফেলে রেখে।
যোগাযোগের আলো-সংকেত থেকে বিকৃত আর হঠাৎ বেড়ে যাওয়া একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে বারবার। তারপর বৃহস্পতির নিজস্ব তেজস্ক্রিয়তার অর্থহীন একমাত্র শব্দ শোনা গেল যা মহাজাগতিক রশ্মি ও সুরের মধ্যে পড়ে। কোনো মানেই নেই এর।
জিয়াংয়ের আওয়াজ আর শোনা যাচ্ছে না। তবে অদৃশ্য হয়ে যায়নি এখনো। ডিসকভারি থেকে উঠে আসা পুঁচকে স্ফুলিঙ্গটা গ্রহের সূর্যমুখী দিক থেকে বোঝা যায় এমনভাবে চলাচল করছে। তাড়াতাড়ি রাতের পাশে অর্থাৎ সূর্যবিমুখী দিকে হচ্ছে বিলীন। এভাবে যদি জিয়াং যেতে থাকে তবে বৃহস্পতি শিপটার গতি ধ্বংস করে কজায় নিয়ে নেবে। পরের বার দৈত্যাকার বিশ্বের পেছন থেকে যখন উঠে আসবে, জিয়াং হবে বৃহস্পতির অন্য এক উপগ্রহ।
মিট মিট করে জ্বলছে ফুলিঙ্গ। জিয়াং গ্রহটার বাঁক ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েছে রাতের পাশে। ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার আগে কিছুই দেখা যাবে না। সব ঠিক মতো চললে এক ঘণ্টার ভেতরে বেরুবে জিয়াং। চাইনিজদের মনের জন্য তা হবে খুব দীর্ঘ সময়।
প্রধান বিজ্ঞানী ভ্যাসিলি অর্লোভ আর যোগাযোগ প্রকৌশলী শাসা কোভালেভের হিসেবে ঘন্টাটা পেরিয়ে গেল খুব তাড়াতাড়িই। ঐ ছোট্ট তারা দেখে ওরা পেয়েছে অনেক শিক্ষা। এর হাজির হওয়া এবং হারিয়ে যাবার খবরাখবর ভয়াবহ। আলোর ডপলার শিফট দিয়েছে জিয়াংয়ের নতুন কক্ষপথের আসল খবরটা। লিওনভের কম্পিউটারগুলো সব চিত্র ধরে রেখেছিল আগেই। বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে সরণের হার সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা থাকাই স্বাভাবিক লিওনভের কম্পিউটারে। তার উপর ভিত্তি করে জিয়াংয়ের উঠে আসার সময়ও বের করেছে।
ভ্যাসিলি কম্পিউটার ডিসপ্লে সুইচ বন্ধ করে চেয়ারে বসে চারদিকে ঘুরে সীট বেল্ট ঢিলা করল। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে বাকিরা। ভ্যাসিলি একটু ভেবে শুরু করল বলা।
সময়মতো ডিস্টার্ব করতে এসেছ? ওটা বৃহস্পতিকে ঘুরে বেরিয়ে আসবে বেয়াল্লিশ মিনিটের মধ্যে। তোমরা একটু ঘুরতে যাচ্ছ না কেন? সব ঠিকমতো করতে হলে মনোযোগ দিতে হবে। তোমাদের সাথে আবার দেখা হবে পঁয়ত্রিশ মিনিট পর। যাও! যাও! বাজে বন্ধুর দল।