লিওনভের আছে বিশাল চার চারটা জ্বালানি ট্যাংক। ট্রান্সফার অর্বিট সফল হবার সাথে সাথে সংখ্যায় কমে যাবে এগুলো। ট্যাঙ্ক বাদ দিলে অবাক করা ঘোঁট এ রাশিয়ান স্পেসশিপ। তাপ-ফলক থেকে ড্রাইভ ইউনিট পর্যন্ত পঞ্চাশ মিটারের চেয়েও কম; বিশ্বাস করা কঠিন যে অনেক কমার্শিয়াল এয়ার ক্রাফটের চেয়ে ছোট এমন এক মাঝারি ধরনের যান দশজন পুরুষ-মহিলাকে সৌর জগতের এক মাথা থেকে প্রায় অন্য মাথায় বয়ে নিয়ে যেতে পারে।
কিন্তু জিরো গ্র্যাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণহীনতা জীবনযাপন প্রণালীর সব বিধিকে ভিন্ন রীতিতে দ্বিতীয়বার লিখেছে। এ পরিবেশে দেয়ালই ছাদ এবং মেঝে। লিওনভে প্রচুর জায়গা, এমনকি যখন সবাই একই সাথে জেগে থাকে তখনো। হরেক রকম সংবাদদাতা, প্রকৌশলী এবং উদ্বিগ্ন কর্মচারীর চূড়ান্ত কষ্টের ফসল এটা। অবাক ব্যাপার, প্রয়োজনীয় জায়গা সাধারণের চেয়ে কমপক্ষে দ্বিগুণ। লিওনভ ডকে থামার সাথে সাথে ফ্লয়েড জেগে ওঠে কার্নো আর চন্দ্রের সাথে। সে কেবিন খুঁজে বের করার চেষ্টা করল যেখানে আগামী এক বছর থাকতে হবে। পরিপাটি উন্নত যন্ত্রপাতি আর খাবারের বাক্স-পেঁটরায় ঠাসাঠাসি করে বোঝাই ঘরটা। ঢাকাই অসম্ভব। ক্রুদের একজন হ্যান্ডহোল্ড থেকে হ্যান্ডহোল্ড ধরে দক্ষতার সাথে দরজার দিকে যাবার সময় ফ্লয়েড বিষণ্ণচিত্তে চারদিকে তাকিয়ে ভাবে কীভাবে দরজায় এক পা রাখা যায়। ক্রু ভদ্রলোক ফ্লয়েডকে উভয় সংকটে পড়তে দেখেই একটু থামল।
ডক্টর ফ্লয়েড যে-ওয়েলকাম-আসনু। আমি সহকারি প্রকৌশলী-ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কি।
রুশ যুবক একজন শিক্ষানবিশের মতো ধীর যত্নে গড়া ইংরেজিতে কথা বলে। বোঝাই যায় ওর বাস্তব ইংরেজি টিচার ছিল না। বরং গৃহশিক্ষকের কাছে পাঠ নিয়ে বসেছে বেশি। হাত মেলাবার সময় ফ্লয়েড ইতোমধ্যে পড়া ক্রুদের বায়োডাটার সাথে তার চেহারা আর নাম মিলিয়ে নিল…ম্যাক্সিম আন্দ্রেই ব্রেইলোভস্কি, বয়স একত্রিশ, লেনিনগ্রাদের মানুষ, নির্মাণ বিশেষজ্ঞ, শখ বেশ ভাল-তলোয়ার চালানো, স্কাই সাইক্লিং, দাবা।
তোমার দেখা পেয়ে খুশি হলাম। ফ্লয়েড বলল, ভিতরে যাব কীভাবে বলতো?
ভয় নেই। দাঁত কেলিয়ে ম্যাক্স বলল, তুমি ঘুম থেকে জেগে দেখবে এসব চিচিং ফাঁক। তা-তোমরা ইংরেজিতে কী বলো শব্দটা?- এক্সপেনসিভ। ব্যাপারটা ব্যয়সাধ্য। আমরা খাব। তোমার রুম প্রয়োজনের সময় খালি হয়ে যাবে। আমি কথা দিচ্ছি। সে তার পেট চাপড়ায়।
ভাল কথা কিন্তু তোমার পেটে এ ঘরে তাবৎ জঞ্জাল যাবার আগে আমার জিনিসপত্র রাখি কোথায়? ফ্লয়েড তিনটি বাক্স দেখালো, মোট ওজন পঞ্চাশ কেজি। সে আশা করছে পরবর্তী লক্ষ কোটি কিলোমিটার পথের জন্য তার প্রয়োজনীয় সবকিছু আছে এর মধ্যে। এদের ওজনহীন করা সহজ কাজ, কিন্তু জড়তাহীন নয়, শিপের করিডোরের ভিতরে সামান্য ধাক্কাতেই জড়তাটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
ম্যাক্স ব্যাগগুলোর দুটো তুলে নিল, তিনটা বিম দিয়ে ছেদ করা ত্রিকোণের ভিতরে সতর্কভাবে বয়ে চলল। নিউটনের প্রথম সূত্রকে উপেক্ষা করে প্রকাশ্যে ঝাঁপও দিল ছোট হ্যাঁচওয়ের ভেতর। অন্যদিকে ফ্লয়েড তাকে অনুসরণ করে অর্জন করল কিছু অতিরিক্ত আঘাতের দাগ। বয়েস হয়ে যাচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ থেকে ধাতস্থ হবার পর মনে হয় লিওনভ বাইরের চেয়ে ভেতরে বড়। স্লাভ এবং রোমান এ দু বর্ণমালার কাপ্তান লেবেল লাগানো এক দরজার কাছে। এল তারা। ফ্লয়েড বলার চেয়ে রাশিয়ান ভাষা পড়তে পারে বেশি। ইশারাকে ঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। সে এরইমধ্যে লক্ষ্য করেছে যে শিপের সব নোটিশে দুটো ভাষা।
ম্যাক্স নক করার সাথে সাথে সবুজ আলো জ্বলে উঠেছে। ফ্লয়েড যতটা সম্ভব সুন্দরভাবে অবস্থার বশবর্তী হয়ে ভেতরে ঢোকে। ক্যাপ্টেন অর্লোভার সাথে বহুবার সে কথা বলেছে কিন্তু এর আগে কখনো তাদের দেখা হয়নি।
ভিউফোনের মাধ্যমে কোনো মানুষের বাস্তব আকৃতি বিচার করা কঠিন। ক্যামেরা কীভাবে যেন সবাইকে একই আকারে নিয়ে আসে। বাকি সবার শূন্য মাধ্যাকর্ষণে দাঁড়ানোর মতো করেই দাঁড়িয়ে আছে কাপ্তান অর্লোভা। খুব বেশি হলে ফ্লয়েডের কাঁধ পর্যন্ত লম্বা। এক মুহূর্তে উজ্জ্বল নীল চোখের ঐ তীক্ষ্ণতা আর চমক লাগানো সুন্দর মুখের ঐ দারুণ বৈশিষ্ট্যের সৌন্দর্য বিচার করা অসম্ভব। মরার ভিউফোন তাও জানাতে পারেনি।
হ্যালো তানিয়া, ফ্লয়েড বলে, অবশেষে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় কী চমৎকৃত হলাম! কিন্তু তোমার চুলের এ কী হাল?
তারা হাত মেলায় পরিচিত বন্ধুর মতো।
আমিও শিপে তোমাকে পেয়ে খুশি হলাম, হেউড! উত্তর দিল ক্যাপ্টেন। তার ইংরেজী বেইলোভস্কির মতো নয়, দক্ষতা আছে পুরোপুরি, যদিও কথাগুলো বেরিয়েছে খুব জোর দিয়ে, হ্যাঁ, চুল হারিয়ে কিছুটা মন খারাপতো হবেই-কিন্তু লম্বা মিশনে চুল মহা বিড়ম্বনা…আমি এখানকার নাপিতকে যতদূর সম্ভব সরিয়ে রাখতে চাই। তোমার কেবিনের জন্য দুঃখিত; ম্যাক্স সব বলেছে আমাকে। হঠাৎ দেখি মালামাল রাখতে আরো দশ বর্গমিটার জায়গা দরকার। পরের কয়েক ঘণ্টায় ভ্যাসিলি আর আমি এখানে বেশিক্ষণ থাকব না-আমাদের কোয়ার্টার ব্যবহার করতে দ্বিধা করোনা, প্লিজ।
থ্যাঙ্কস। কার্নো আর চন্দ্রের কী খবর?