আমার জীবনের বিরাট এক মুহূর্ত এটা-ফ্লয়েড মনে মনে ভাবল। আমি এমন এক অভিযানে যাচ্ছি যা মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে। কেন যেন ভিতর থেকে কোনো জয়োল্লাস আসছে না। বরং যেসব কথা বেশি মনে পড়ে…বাড়ি ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ফিসফিসিয়ে বলা কথাগুলো, বিদায় আমার প্রিয় ছোট্ট বাবু, আমি যখন ফিরে আসব তখন আমাকে কি তুমি চিনতে পারবে? এখনো রাগ লাগছে ক্যরোলিনের উপর। সে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল ছেলেটাকে-ক্যারোলিন জাগায়নি। তবু সে ক্যারোলিনের কাজটাকেই ঠিক মনে করে। না জাগানোটাই ভাল।
হঠাৎ এক বিস্ফোরিত অট্টহাসিতে তার মন-খারাপ ভেঙেচুরে গেল; ডক্টর কার্নো কৌতুক করছিল সাথীদের সাথে। একটু, সামান্য প্রটোনিয়াম যতোটা কোমলভাবে মানুষ নেয় তেমন করে সে ধরে রেখেছে বিরাট এক বোতল।
সে ডাকল, এই হেউড, লোকজন কী বলে বেড়ায় বলতো! কাপ্তান অর্লোভা নাকি সব পানীয় ভরে রেখেছে সিন্দুকে, এটাই আমার শেষ সুযোগ। সেতিউ থিয়োরী ৯৫। প্লাস্টিক কাপে খেতে হচ্ছে, হায় কপাল!
একেবারে খাসা শ্যাম্পেন, যখন ফ্লয়েড একটু একটু করে চুমুক দিয়ে পান করছে। তখন কার্নো হাসছে আর হাসাচ্ছে বেদম। সৌরজগৎসহ সব দিকে কার্নোর অট্টহাসির ধ্বনি প্রতিধ্বনির সামনে ফ্লয়েড নিজে যেন নুয়ে পড়া এক মানুষ। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে ইঞ্জিনিয়ারের ক্ষমতা। মিশনের সঙ্গী হিসেবে কার্নো শক্তি প্রয়োগ করার মতো প্রমাণ দেখাতে পারত। অন্তত ডক্টর চন্দ্র তার সমস্যা তুলে ধরত না। ফ্লয়েড খুব বেশি হলে তার কাছে মৃদু হাসি আশা করে। অথচ লোকটা পারেও! নামমাত্র খেয়ে থর থর করে কাঁপিয়ে উল্টে দিল শ্যাম্পেনের কাপ; নাহ্, কার্নো যথেষ্ট মার্জিত, অথবা যথেষ্ট আনন্দে আছে, অথবা লুকাচ্ছে মনের ব্যথাটুকু। নিজেকে প্রচার করার জন্য এ কাজ করেনি।
ইঞ্জিনিয়ার মনে হয় এ পার্টির মধ্যমণি হওয়ার পণ করেছে। একটু আগে সে একটা দু-দিকে অ্যাকটিভ ইলেকট্রনিক কীবোর্ড নিয়ে সহগামীদের কণ্ঠের সহযোগিতায় পর পর পিয়ানো, ঐম্পেট, বেহালা, বাশের বাঁশি এবং গান দিয়ে দ্রুত শুনিয়ে দেয় ডাইকেন জন পিল। ও আসলে খুব ভালো আছে।
একটু পরই ফ্লয়েড নিজেকে গাইতে দেখল অন্যদের সাথে। কিন্তু সে মনে করেছিল কার্নো তার যাত্রার সময়টা কাটাবে নীরবে, হাইবারনেশনের আঁধারে। ইঞ্জিন জ্বলার পর যখনি শাটল নিজে নিজে আকাশে চলতে শুরু করছে তখনি হতাশায় বন্ধ হয়ে গেল গান। ফ্লয়েড এক পরিচিত কিন্তু সদা নতুন উল্লাসে জড়িয়ে নেয় নিজেকে। অসীম ক্ষমতার ইন্দ্রিয় পৃথিবীর যত্ন এবং শক্তি থেকে নিয়ে যাচ্ছে উপরে, বহু দূরে। মানুষ এক সময় ঈশ্বরের অস্তিত্বকে মাধ্যাকর্ষণের নাগালের বাইরে বসায়, তারপর উপলব্ধির চেয়ে জানতে পারে বেশি। সে উড়ছে স্বাধীন ওজনহীনতার কল্পলোকে। মুহূর্তের জন্য হয়ত সত্যটা গেছে ভুলে। সেখানে কোনো স্বাধীনতা নেই, আছে শুধু তার অতীত ক্যারিয়ারের গুরুদায়িত্ব।
ইঞ্জিনের গতি বাড়ার সাথে সাথে ওজন যেন ফ্লয়েডের কাঁধে বসছে জাঁকিয়ে। কিন্তু সুনয়না পৃথিবীর এত ভার বহন করেও ক্লান্ত না হয়ে সে একে স্বাগত জানিয়ে নিল। ভাবতে চেষ্টা করেনি, কিন্তু এসব অভিজ্ঞতার স্বাদ উপভোগ করে তৃপ্তি পায়। ফ্লয়েড যদিও শেষবারের মতো পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছে এবং যাদের এখনো ভালবাসে তাদের বিদায় জানাচ্ছে তবু অনুভব করছে না কোনো দুঃখ। তার চারদিকের গর্জন বিজয়োল্লাসের বন্দনা গান হয়ে যেন ছোটখাট আবেগগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। এখান থেকে যাবার সময় সে ব্যথা পায়, পৃথিবীর আকর্ষণ যাচ্ছে চলে। সহজতর শ্বাসপ্রশ্বাস এবং হঠাৎ ইন্দ্রিয় স্বাধীনতাকেও স্বাগতই জানায়। যাত্রীদের প্রায় সবাই সিট বেল্টে ঢিল দিতে শুরু করেছে, কক্ষপথ অতিক্রমের সময় শূন্য মাধ্যাকর্ষণের তিরিশ মিনিটকে উপভোগ করতে চায়। কিন্তু যারা প্রথম এ জার্নি করছে তারা সিটে বসে থেকেই কেবিন অ্যাটেনড্যান্টদের জন্য চারদিকে উদ্বিগ্নভাবে তাকাতে থাকে।
ক্যাপ্টেন কথা বলে, আমরা এখন সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে তিনশ কিলোমিটার উপরে আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিম উপকূলের উপর। আপনারা ভাল দেখতে পাবেন না। সেখানে এখন রাত। সামনে যে উজ্জ্বলতা দেখা যাচ্ছে তা হল সিয়েরা লিওন এবং গিনির উপসাগরের উপরে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বিরাট ঝড়। তাকিয়ে দেখুন ঐসব আলোর ঝলক।
পনের মিনিটের মধ্যে আমরা সূর্যের আলো দেখতে পাব। ইতোমধ্যে শিপকে ঘোরাচ্ছি যাতে আপনার বিষুবরেখার কাছাকাছি স্যাটেলাইট এলাকার সুন্দর দৃশ্য দেখতে পারেন। প্রায় সোজাসুজি মাথার উপর উজ্জ্বলতম যা দেখা যাচ্ছে ওটা ইনটেলমেট আটলান্টিক ওয়ান অ্যান্টেনা ফার্ম। তার পরেরটা পশ্চিম দিকে দেখুন ইন্টারকশন্স টু। আর এক অস্পষ্ট তারার মতো যেটা দেখছেন…ওটাই বৃহস্পতি। যদি ওটার ঠিক নিচে তাকান, এক আলোর চমক দেখতে পাবেন। তারার পিছনে বিপরীত দিকে নড়াচড়া করছে। ওটাই হলো নতুন চাইনিজ মহাশূন্য স্টেশন। আমরা একশ কিলোমিটার দূর দিয়ে পেরুচ্ছি, খালি চোখে দেখার মতো যথেষ্ট কাছে নই।
ফ্লয়েড আলসের মতো ভাবল-এতক্ষণ ওগুলো কী দেখলাম? মোটা নলের মতো কাঠামোটার আরো কাছে এসে সে পরীক্ষা করেছে। ভীতুদের গুজবে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তারা বলে ওটা এক লেজার সজ্জিত দুর্গ। তারপর সবার সন্দেহের কারণে জাতিসংঘ চীনাদের তথাকথিত লেজার দুর্গ দেখতে চায়। বেইজিং বিজ্ঞান একাডেমি জাতিসংঘের মহাশূন্য কমিটির পরিদর্শনে যাত্রার অনুরোধ একের পর এক ফিরিয়ে দিয়েছে। শত্রুদের এসব প্রচারের জন্য চীনারা দোষ দেয় নিজেদের। নভোচারী এলেক্সি লিওনভ স্পেসশিপটা খুব একটা সুন্দর কিছু না। কিছু মহাশূন্যযান দেখতে সুন্দর। সম্ভবত মানবজাতি একদিন নান্দনিক নতুন কিছু উন্নয়ন করবে। শিল্পীদের প্রজন্ম উঠে আসবে যাদের শিল্প আদর্শটা বায়ু ও পানির ছাঁচে তৈরি পৃথিবীর প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি। মহাশূন্য নিজেই মাত্রাছাড়া সৌন্দর্যের এক কল্পলোক; দুর্ভাগ্যক্রমে মানুষের হার্ডওয়্যার নিজেকে এখনো পূর্ণতা দান করতে পারেনি।