ভাল কথা, আমার ভাবনা মোটেও জলদস্যুর মতো না। আমি লুটের পরে বা লুটের সময় যাই না, যাই আগে এবং যা চাই…আসল ব্যাপার হল দুঃসাহসিক অভিযান।
তাহলে তুমি কেন শুধু শুধু… না, আর ঝগড়া করার ইচ্ছা নেই। কিন্তু এখন ঝগড়াও আমাদের দুজনকে সাহায্য করবে, যদি নিজের মনোভাব ঠিকভাবে তুমি বুঝতে পার।
মনে হয় ভাল একটা কারণ তোমাকে দেখাতে পারব। আমার ছোট ছোট অনেক শত্রুর মধ্যে একজন খুব শক্ত। সে আর তার দল সবশেষে এমন কিছু বোঝাতে চায় যা কল্পনাও করিনি-বিশ্বাস কর আমাকে।
আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। কিন্তু তুমি কি শিওর আমাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছ।? যাবার একটা ছুতো দিয়ে বোকা বানাচ্ছ না নিজেকেই?
যদি তা করেও থাকি, বলতে হয়, তবে এমন নিজেকে বোকা বানানো আরো প্রচুর লোক আছে। মনে রেখ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টও জড়িত।
আমি ভুলিনি। কিন্তু ধরো-স্রেফ ধরে নাও-সে তোমাকে যেতে বলেনি। তুমি কি সেধে যাবে?
সত্যি বলব? কখনোই নিজের ইচ্ছায় এমন মিশনে যাব না। প্রেসিডেন্ট মারডেসির ডাক আমার জীবনে সবচে বড় আঘাত। আঘাতটা শেষ হওয়ার পর বুঝেছি তার কথাই ঠিক। তুমি জান, আমি মিথ্যা বিনয়ের প্রতিযোগিতায় নামি না। ঐ চাকরির জন্য অ্যামিট সবচে যোগ্য-যখন মহাশূন্য ডক তাদের ফাইনাল সম্মতি দেবে। আমি এখনো ভাল আছি, ক্যারোলিন।
সে মুখে হাসি ফোঁটায় বহু কষ্টে, মাঝে মাঝে আমার মনে হয়…তুমিও কিন্তু কথাটা তাদের বলতে পার। অ্যামিট আরেকজন যোগ্য লোক। হয়ত তুমি সেধেই যেতে চাও।
এমন ভাবনা বাসা বেঁধেছে ফ্লয়েডের ভিতরেও। কিন্তু সে উত্তর দিল সুন্দর মনে, আমি তোমার সাথে পরামর্শ না করে কখনো এমন কিছু করব না।
করোনি শুনে ভাল লাগছে। জানিনা কী বলতাম যদি তুমি…
এখনো তাদের অফার ফিরিয়ে দিতে পারি।
বাজে কথা বাদ দাও, তুমিতো জান। যদি যাওয়ার অফারটা ফিরিয়ে দাও তাহলে বাকি জীবন আমাকে ঘৃণা করবে-তোমার নিজেকেও কখনো ক্ষমা করবে না। তুমি কর্তব্য ঠিকই চিনতে পার। হয়ত যেজন্যে তোমাকে বিয়ে করেছি তার মধ্যে এও এক কারণ।
কর্তব্য! হ্যাঁ, সেটাই আসল কথা এবং কী অবাক করা কর্তব্য যে চারপাশে! নিজের প্রতি তার কর্তব্য ছিল, কর্তব্য ছিল পরিবারের প্রতি, ইউনিভার্সিটির প্রতি, তার অতীত কাজের প্রতি (এমনকি সন্দেহের প্রতিও)-এবং মানবজাতির প্রতি। কোনো কর্তব্য আগে আসবে সে অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সহজ নয়; মাঝে মাঝেই কর্তব্যেরা একে অন্যের বিরোধী যে!
এ মিশনে যাওয়া আসলেই দরকার। যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে-একইভাবে কেন মিশনে তার যাওয়া ঠিক না তা নিয়েও ফ্লয়েডের অনেক বন্ধু দেখিয়েছে বেশ কিছু যুক্তি। কিন্তু সম্ভবত সবশেষে হাজার হিসাব শেষ করে তার মস্তিষ্ক নয়, হৃদয়ই ঠিক করল সে কী করবে। এখানে তাকে দুটো বিপরীত দিকে ঠেলে দিচ্ছে আবেগ।
যেতে হবে বৃহস্পতির দিকে। জানার ইচ্ছা, অপরাধের অপবাদ, নিজের গোয়ার্তুমি এসব একত্র হয়ে ভয়াবহ একটা কাজ শেষ করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন; যা-ই হোক না কেন। অন্য দিকে ভয়-পারিবারিক ভালবাসা তাকে পৃথিবীতে রাখার কথাও বলে। তবু কোনো সন্দেহ নেই। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি, সেখানে স্থির থাকতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না সে। সিদ্ধান্ত নেয়ার সাথে সাথেই ক্যারোলিনের যত আপত্তি যতোটা সম্ভব ভদ্রতার সঙ্গে দিয়েছে সরিয়ে।
আরও একটা সান্ত্বনা দেয়া চিন্তা আছে তার মনে। ঝুঁকি শুধু নিজেই নিচ্ছে, পরিবারের আর কেউ না। আড়াই বছরের জন্য যেতে হবে। এর মধ্যে বৃহস্পতিতে থাকার সময়টা বাদ দিয়ে বাকি অসীম সময় কাটাতে হবে হাইবারনেশনে। ফিরে এলে বয়সের পার্থক্য কমে যাবে দু বছরের মতো। কিংবা আরো বেশি। ফলে তারা বয়সে অনেক এগিয়ে আসছে; শুধু ক্যারোলিনকে থাকতে হবে একা।
৫. লিওনভ
কীভাবে কোনো ফাঁকে মাস ছোট হয়ে সপ্তাহ হয়ে যায় কেউ জানে না, সপ্তাহ কমে হয় দিন, আর দিন ঘণ্টার দিকে যায় কুঁচকে। হেউড ফ্লয়েড অনেক বছর আগে ক্ল্যাভিয়াস বেসে টাইকো মনোলিথ দেখতে যাবার পর এই প্রথম বাধ্য হয়ে যাত্রা করছে মহাকাশে।
কিন্তু এবার সে একা নয়। মিশন নিয়ে কোনো গোপনীয়তাও নেই। সামনের কয়েক সিট পরে বসে ডক্টর চন্দ্র। সে ব্রীফকেস কম্পিউটারের সাথে এরই মধ্যে এত আলাপে ব্যস্ত যে চারদিকের পরিবেশ তাকে তেমন সহজভাবে নেয়নি।
কিছু বিশ্বাস আছে যা কখনো কাউকে বলা যায় না। মানুষ যতই মানুষ হোক, অন্য প্রাণীর সাথে তার প্রচণ্ড মিল পাওয়া যায়, সেটুকু যেন অন্তঃসলিলা নদী। আইডিয়াটা ফ্রয়েডের গোপন মজার ব্যাপারগুলোর একটা। তবে মিলগুলোকে সে অপমান করার কাজে লাগায় না বরং আরো সুন্দররূপে উপস্থাপিত করে। তার এ ছোট্ট শখটা মুখস্থ রাখার কাজ দেয়।
ডক্টর চন্দ্র এখন যেমন করছে তা যেন মনের ভেতর হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা পাখির নাচনের মতো। সে দেখতে ছোটখাট, কোমল এবং তার সব চলাফেরা বেগবান আর নির্ভুল। কিন্তু কোন্ পাখি? নিশ্চই খুব বুদ্ধিমান একটা পাখি। ম্যাগপাই? অত্যন্ত কিচিরমিচির করে কিন্তু লোকজন তেমন দেখতে পারে না। তাহলে পেঁচা? নাহ্-খুবই কচ্ছপগতির। সম্ভবত চড়ুইপাখি চমৎকার মানায়।
ডিসকভারিকে আবার সচল করার মতো ভয়ানক কাজের দায়িত্ব সিস্টেম বিশেষজ্ঞ ওয়াল্টার কার্নো নিয়েছে। আসলে কাজটা আরো কঠিন। সে বিশালদেহী কর্কশ লোক, মোটেই পাখির মতো নয়। বিপুল বিস্তৃত ধারার কুকুরের মধ্যে কোথাও কেউ এমন কিছু খুঁজে পাবে, কিন্তু তুলনাটা ঠিক মানানসই না। কার্নো অবশ্যই এক ভালুক। গোমড়ামুখো নয়, বিপজ্জনক প্রকৃতির, কিন্তু ভালমানুষ ধরনের। আর বন্ধু ভাবাপন্ন। সম্ভবত তাই ঠিক; ভাবনাটা ফ্লয়েডকে রাশিয়ান সাথীদের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাদের সাথে অচিরেই সে যোগ দিতে যাচ্ছে। চূড়ান্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজে তারা বহুদিন যাবৎ ঝুলে আছে উপরের অর্বিটে।