আমি… শুনে… খুব… খুশি…।
কথাটা শেষ করার আগেই ফ্লয়েডের কথা কয়েক মাসের জন্য হারিয়ে গেল ঘুমের জগতে। কিন্তু সে এখনো অচেতন হয়ে যায়নি, এখনো তার মেধার কিছু অংশ কাজে লাগিয়ে সে বুঝতে পারে নতুন পরিস্থিতিটাকে।
আসলেই বিশ্বাস করি না আমি, নিজেকেই সে বলল। ওয়াল্টার হয়ত জেগে উঠেই সিদ্ধান্ত বদলে নেবে…
অবশেষে একটা চুড়ান্ত ভাবনা তার মনে বাসা বাঁধল, যখন সে তলিয়ে যাচ্ছিল ঘুমের অতলে। ওয়াল্টার যদি সিদ্ধান্ত বদলে নেয়, তো তার না জেগে ওঠাই ভাল,..
ডক্টর হেউড ফ্লয়েড ভেবেছিল ব্যাপারটা দারুণ মজার।
বাকি সব কু প্রায়ই চমকে যেত, পৃথিবী ফেরার পথে। সারাটা পথ হাইবারনেশনে ডক্টর হেউড ফ্লয়েড কেন মুচকে হেসেছে?
কেউ জানে না।
৫৫. জেগেছে লুসিফার
একাধারে বছরের বেশ কয়েকমাস পৃথিবীর রাতের আকাশকে নরম আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দেয় পূর্ণিমার চাঁদের চেয়ে অর্ধশতগুণ উজ্জ্বল লুসিফার। কার্যকারিতায় অদ্ভুত মিল ছাড়াও এর এমন নাম দিতেই হত; কারণ আলোর বন্যায় ভালোর সাথে সাথে মন্দও এসেছে দেদার। পরের শতাব্দী আর সহস্রাব্দগুলোই শুধু বলতে পারবে কোথায় এ ভারসাম্যের শেষ।
ভাল দিকের মধ্যে পড়ে-রাতের আগমন আর মানুষের কাজের কোনো বাধাই দেয় না। মানুষ সত্যি সত্যি চব্বিশ ঘণ্টায় দিন পেয়েছে। তার মধ্যে অর্ধেক গোধূলী, তাতে ঘুমের কোনো অসুবিধা হবে না-কাজেরও না। মানব সভ্যতার গতি দ্বিগুণ হল এবার। অন্তত যেসব দেশে সভ্যতার গতির প্রয়োজন, সেসব স্বল্পোন্নত দেশ উড়ে চলেছে কোনো এক অজানার উদ্দেশ্যে। বিদ্যুতের চাহিদা গেছে কমে, আবার পুরো সভ্যতাই তেলের যুগ পেরিয়ে সৌরযুগে এসে পড়ায় চব্বিশ ঘণ্টা সৌর শক্তি সংগ্রহ করা যায়। কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন অকল্পনীয় হারে কমেছে, আর এ কাজেই প্রাচীনতম যুগ থেকে মানুষ সবচে বেশি শক্তি খরচ করে। সবচে বড় প্রভাব হল-শক্তি বাঁচছে, ধোয়া হচ্ছে না, যত বেশি উদ্বৃত্ত শক্তি ততো বেশি সামনে চলা। পরিবেশ দূষণ অত্যন্ত কম। তেল-গ্যাসের বদলে চব্বিশ ঘণ্টার সৌর ব্যবস্থা নেয় সবাই। এমনকি বাকি মাসগুলোয় দিনের লুসিফার মেঘের আঁধারকে দূরে সরিয়ে দেয়, ঝলমল করে আকাশে।
কৃষক, মেয়র, সিটি ম্যানেজার, পুলিশ, নাবিক, এবং আর যারা দরজার বাইরে কাজ করে-বিশেষত দূরের এলাকাগুলোয়, তারা অসম্ভব খুশি। কিন্তু প্রেমিক প্রেমিকা, অপরাধী, প্রকৃতিবিদ আর অ্যাস্ট্রোনোমারদের শত্রু এ নক্ষত্র।
প্রথম দু দল তাদের সক্রিয়তায় সাংঘাতিক বাধা পেয়েছে, অন্যদিকে প্রকৃতিবিদেরা দিনরাত ঘুমাতে পারছে না পৃথিবীর গাছ আর প্রাণীর উপর লুসিফারের কী প্রভাব পড়বে তা ভেবে। অনেক অনেক নিশাচর প্রাণীর খুব ক্ষতি হয়ে গেল, বাকিরা মানিয়ে নিচ্ছে মোটামুটি। কিছু প্যাসিফিক খাবার যোগ্য সামুদ্রিক প্রাণীর জন্ম সরাসরি চাঁদ প্রভাবিত জোয়ারের উপর নির্ভর করে। সেই জোয়ার প্রভাবিত করেছে লুসিফার। কোনো কোনো মাছের জন্য দরকার চাঁদহীন রাত, তারা মরার আগেই কবরখানায় পড়ে আছে। কোনো কোনো প্রাণী আবার দ্রুত বংশবিস্তার করছে, ফলে তাদের খাদ্য যেসব প্রাণী, সেগুলো অনেক এলাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, আবার সেসব খাদ্যকে অন্য যে প্রাণীরা গ্রহণ করে তারাও যাচ্ছে হারিয়ে। ভরের পিরামিড, খাদ্যচক্র, বস্তুতান্ত্রিক নির্ভরতা-সব যাচ্ছে বদলে।
বেশিরভাগ উদ্ভিদের উপরই পড়ছে অকল্পনীয় প্রভাব। দিবা-দৈর্ঘ্যের গাছগুলো পড়েছে মহা সমস্যায়। দিন-নিরপেক্ষ গাছেও প্রভাব পেয়েছে সালোক সংশ্লেষণের আঁধার পর্যায়; খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া-যাকে বলে শ্বসন; বাড়তি পানি আর গ্যাস বের করে দেয়ার কাজ বা প্রস্বেদন; ক্রেবস চক্র, প্লাস্টিডের গঠন এসব দিকে পড়ছে প্রভাব।
এর উপর লুসিফারের সম্ভাব্য তেজস্ক্রিয়তা আর ক্ষতিকর রশ্মির প্রভাব নিয়েও আলোচনা হচ্ছে, তবু এ প্রভাব দুটো তেমন পড়বে না। আর পরিবেশবিদরা ভাল প্রভাবকে এড়িয়ে যায় বরাবর। সবশেষে ফলন যে অসম্ভব বেড়েছে সেটা তারা মানতে চায় না।
আর ক্ষেপেছে পৃথিবীর অ্যাস্ট্রোনমাররা। এটাকে তারা এখনো দুর্ঘটনা মনে করে। বেশিরভাগ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল যন্ত্রপাতি আর পরীক্ষা স্পেস আর চাঁদের সম্পত্তি। সেগুলোকে লুসিফারের করাল দৃষ্টি থেকে সহজেই লুকিয়ে ফেলা যায়, কিন্তু পৃথিবীর যন্ত্রপাতিগুলো বিরাট সমস্যায় পড়ে। এককালের অন্ধকার আকাশ আজ আলোকিত-এদিকে এগুলোকে বছরে তিনবার পৃথিবীর তিন প্রান্তে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব না!
মানবজাতি হয়ত মানিয়ে নেবে। এর আগের বহু পরিবর্তনের সাথে নিয়েছে মানিয়ে। একটা প্রজন্ম চলে আসবে যারা লুসিফার ছাড়া আকাশকে কোনোদিন মেনে নিতে পারবে না। তাদের কেউ কেউ রাতভর জেগে থেকে বিভোর হবে লুসিফারের জোছনায়। রূপকথা আসবে উঠে। আসবে কবিতার পর কবিতা। আর এ উজ্জ্বলতম তারকা শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক ভাবুক নরনারীর কাছে অসীম রহস্যের আধার হয়েই থাকবে।
বৃহস্পতিকে কেন উৎসর্গ করতে হল-কতদিন নতুন সূর্যটা আলো ছড়াবে? জ্বলে যাবে তাড়াতাড়ি, নাকি হাজার হাজার বছর ধরে বিকিয়ে যাবে শক্তির বন্যা-মানব সভ্যতার শেষ পর্যন্ত?
এত কিছুর পরও সবচে বড় প্রশ্ন, শুক্রের মতো মেঘে মেঘে ছাওয়া সুন্দর এক গ্রহ- ইউরোপা। তার উপর নিষেধাজ্ঞা কেন?