শেষবারের মতো ডিসকভারির জেটগুলো শনির বুকে পোড়া অণু-পরমাণুর হক্কা বইয়ে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নিজের চিরকালীন আবাসে। কেমন একটু গর্ববোধ করে বোম্যান-সাথে একটু কষ্টও পায়। এই অসাধারণ ইঞ্জিনগুলো অসম্ভব কাজ করেছে। ডিসকভারিকে পৃথিবী থেকে চাঁদ, চাঁদ থেকে বৃহস্পতি, বৃহস্পতি থেকে নিয়ে এসেছে শনিতে; এই তাদের শেষ কাজ। নিজের প্রপেল্যান্ট ট্যাঙ্কগুলো খালি করলে আর সব মহাজাগতিক বস্তুর মতোই সে এক সামান্য উল্কা হয়ে মহাকাশে অভিকর্ষের দাসানুদাস বনে যাবে। উদ্ধারশিপটা তার জন্য কোনো বাড়তি জ্বালানিও আনতে পারবে না।
উপগ্রহ এগিয়ে আসার সাথে সাথে ফুয়েল গজও দ্রুত শূন্যের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে, বোম্যানের চোখ নেচে যাচ্ছে এসব ডিসপ্লের উপর। সে যদি কয়েক পাউন্ড ফুয়েলের অভাবে কাজ না সারতে পারে তো আর দেখতে হবে না…
ফুয়েলের গর্জন পড়ে যায়, ডিসকভারিও নিজেকে অর্বিটে সামলে নেয়। আরো জ্বালানী বাকী আছে। সারাক্ষণ সে জ্যাপেটাসকে পিচ্চি এক উপগ্রহ ভেবে এসেছে, এবার সামনে থেকে তাকে মোটেও পিচ্চি মনে হচ্ছে না। যেন যে কোনো মুহূর্তে ডিসকভারিকে গুড়ো করে ফেলতে উদ্যত এক মহাজাগতিক হাতুড়ি এই উপগ্রহটা।
এত ধীরে সে এগিয়ে আসে যে ব্যাপারটা বোঝা যায় না। তারপর কখন যেন বোম্যান মাত্র অর্ধশত মাইল নিচে এক অনন্য সৃষ্টিকে দেখতে পায়।
বিশ্বস্ত ছোট জেটগুলো তাদের শেষ শব্দ করেই ডিসকভারিকে পৌঁছে দেয় ঠিক ঠিক অর্বিটে। সে এখন ঘন্টায় আটশো মাইল গতিতে প্রতি তিন ঘণ্টায় চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে জ্যাপেটাসকে।
ডিসকভারি এখন আর কোনো স্পেসশিপের নাম নয়, এক স্যাটেলাইটের নাম।
অধ্যায় ৩৬. বিগ ব্রাদার
‘আমি আবারো দিনের পাশে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। সেই আগের রিপোর্ট করতে হবে আবারও। উপরিতলে মাত্র দু-ধরনের জিনিস চোখে পড়ে, একটা সেই কালো এলাকা-একদম কয়লা… রাতের দিক…অন্যটা নিচের ডিম্বাকার এলাকা…
‘চওড়া এলাকার ব্যাপারে এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। চারপাশ একেবারে মসৃণ, কোনো দাগটাগ বা আর কিছু চোখে পড়ে না। একেবারে সমতল আর…তরলও হতে পারে। তোমরা ছবি দেখে কী মাথামুণ্ডু বুঝবে তা বলতে পারি না, তবে আমার চোখে এ এক জমাট দুধসাগর।
‘এ জিনিসটা কোনো ভারি গ্যাসও হতে পারে…না, অসম্ভব মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে ধাঁধায় পড়ে যাই। এক আধটু জায়গা বদলায় মনে হয়। কিন্তু শিওর হয়ে কিছুই বলতে পারছি না…
‘…নিজের তৃতীয় অর্বিটে আবার আমি সেই সাদা জায়গার উপর এসে পড়েছি। গতবার ঠিক কেন্দ্রে যে মাপটা নিয়েছিলাম সেটা এবার পরীক্ষা করব। আমার আন্দাজ ঠিক হলে এর পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে আমি যাচ্ছিই…এটা যাই হোক না কেন।
‘…ইয়েস! সামনে একটা কিছু দেখা যাচ্ছে। ঠিক যেখানে আমি আন্দাজ করেছিলাম সেখানে। উঠে আসছে! এক মিনিট, টেলিস্কোপটা সরিয়ে নিই…
‘হ্যাল্লো! কোনো ধরনের বিল্ডিং হবে বোধহয়। এক্কেবারে কালো, দেখাই যায় না। কোনো দরজা-জানালা নেই। খালি একটা বিরাট উঁচু স্ল্যাব-এখান থেকে দেখে মনে হচ্ছে কমসে কম এক মাইল উঁচু হবে। এটা দেখেই আমার মনে পড়ে গেল… অবশ্যই, কেন নয়? এ তো দেখতে ঠিক তোমাদের চাঁদের জিনিসের মতোই! এটা হল টি এম এ-ওয়ানের বিগ ব্রাদার!’
অধ্যায় ৩৭. অজি শ্রাবণের আমন্ত্রণে দুয়ার কাঁপে
একে নক্ষত্র দুয়ার বলা যায়।
ও ত্রিশ লাখ বছর ধরে আজকের দিনের প্রতীক্ষায় ছিল। এ কাজে একটা উপগ্রহ ধ্বংস করা হয়েছে, তার চিহ্ন আজো ভেসে বেড়ায় শনির চারপাশে।
সেই দীর্ঘ প্রহরের যবনিকা এবার পড়ে গেছে। আরো এক গ্রহে উন্নত জীবনের উন্মেষ ঘটেছে, এর প্রাণীরা নাড়ির বাঁধন ছিঁড়ে চলে এসেছে এতদূর।
এক পুরনো, অতি পুরনো পরীক্ষা এবার নিজের ফলাফল দেখতে পাবে।
অনেক অনেক আগে যারা এ পরীক্ষণ শুরু করেছিল তারা মানুষ ছিল না, তাদের আকৃতি মানুষ থেকে অনেক অনেক দূরে। নিজেদের রক্তমাংসের শরীর নিয়ে বিহ্বল চোখে দূর দিগন্তে তাকালে তারা একাকী বোধ করে, ভর করে কীসের যেন হতাশা, কোত্থেকে যেন দুঃখ এসে জাপটে নেয়। শক্তি অর্জনের সাথে সাথে তারা অনন্ত নক্ষত্রবীথির দিকে ছুটতে শুরু করে অমিত তেজে।
তাদের অভিযানে কত ধরনের জীবন যে চোখে পড়ল! কত অযুত গ্রহের নিযুত প্রাণীর অগুণতি বিবর্তন-পদ্ধতি যে তারা দেখল তার কোনো লেখাজোকা নেই। অন্ত বিহীন নক্ষত্ৰধুলার আলোয় একটু ফিকে হয়ে আসা অসীম মহাজাগতিক রাতে কত বিচিত্র বুদ্ধিমত্তার বিকাশ যে তারা দেখল একমুহূর্তের তারার মতো জ্বলে উঠতে, কত তারাকে দেখল নিভতে!
এবং, যেহেতু সব গ্যালাক্সি চষে ফেলেও মনের চেয়ে দামী কোনো কিছুর সন্ধান তারা পায়নি তাই এর অরুণোদয়কেই তারা সবখানে সবচে বেশি মূল্য দিল। তারা তারার জগতের চাষী, তারা চাষ করে, বোনে, মাঝে মাঝে ফসলও তোলে।
কখনো কখনো হতাশ হয়ে উপড়ে ফেলতে হয় আগাছা।
হাজার হাজার বছরের মহাকাশ অভিযান শেষে তারা যখন পৃথিবীর বুকে পা রাখে তখন ডাইনোসররা বিলুপ্ত এক প্রাণী। জমে থাকা বাইরের গ্রহগুলোর পাশ দিয়ে উড়ে এসে মঙ্গলের মৃতপ্রায় মরুভূমির উপর একটু থামে, তারপর অপার আগ্রহ নিয়ে তাকায় পৃথিবীর দিকে।
নিচে ছড়িয়ে পড়েই অভিযাত্রীরা এক জীবন সাগর দেখতে পায়। বছরের পর বছর ধরে তারা পর্যবেক্ষণ করে, সংগ্রহ করে, শ্রেণীবদ্ধ করে সবকিছুর নাম। জানার মতো সব তথ্য পাবার পর পরিবর্তনে হাত দেয়। বহু প্রাণীর জীবন নিয়ে একটু চেষ্টা করে-তা ভূমিতে হোক আর সাগরে। কিন্তু পরীক্ষা সফল হল কি হল না তা জানতে আরো দশ লক্ষ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাবে।