সেই আত্মার পরও লাভটা কোথায়? তাদের হাতে তো কোটি কোটি বছর থাকে উন্নয়নের জন্য। আরো উন্নত তারা হতেই চাইবে। আরো কিছু বাকি থেকে যায়, আর একটা জিনিস হওয়া বাকী থেকে যায়-তা প্রাণিকুল এখনো হয়নি।
ঈশ্বর।
অধ্যায় ৩৩. রাজদূত
গত তিন মাসে ডেভ বোম্যান এত বেশি একা পড়ে গেছে যে জগতে আর কোনো প্রাণীর অস্তিত্বটাই এখন তার কাছে তাত্ত্বিক সত্যি, বাস্তব নয়।
‘এ্যালোন, এ্যালোন, অল অল এ্যালোন…
এ্যালোন অন এ ওয়াইড ওয়াইড সী…’
কোলরিজের সেই একলা নাবিকের মতো সে এত বেশি একাকী আর হতাশ হয়ে পড়েছে যে বিরাট একটা রুটিনের আড়ালে নিজেকে ঢেকে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে সারাক্ষণ। বাড়তি ভ্যাজাল হিসেবে মেশিন আর সিস্টেমে গণ্ডগোলতো আছেই। তার যোগ্যতা, পরিশ্রম আত্মবিশ্বাস আর সাহস কোনোটা নিয়েই প্রশ্নের অবকাশ নেই কারণ সে মানুষের সর্বকালের সবচে বড় অভিযানের অধিনায়ক। আজো তার কৌতূহল শেষ হয়ে যায়নি।
তার আসন্ন লক্ষ্য যোগায় অমিত আশা, কানে কানে নূতন দিনের গান শোনায়।
সে শুধু মহান মানবজাতির প্রথম আর একমাত্র প্রতিনিধিই নয়, তার পরবর্তী যে কোনো পদক্ষেপের কারণেই মানুষের পুরো ভবিষ্যৎ আর ভাগ্য বদলে যেতে পারে। সে নিজেকে বোঝায়, থামলে চলবে না, ভাঙলে চলবে না। পুরো ইতিহাসে কখনো এমন সময় আসেনি। ডেভ, তুমি ডেভ নও, রাজদূত, মানব সাম্রাজ্যের রাজদূত।
সেই প্রজ্ঞা তাকে বহু সংকীর্ণ পথে আলো দেখায়। সে নিজেকে পরিচ্ছন্ন, ধীমান করে রাখে। যত সমস্যাই হোক, কোনোদিন সে শেভ করাটাও বাদ দেয় না। তাকে দেখে কেউ মানবজাতিকে ভুল বুঝবে নাতো?
মিশন কন্ট্রোল যে তাকে প্রতি পল অনুপলে দেখছে তা সে ভালমতোই জানে। সে প্রতিজ্ঞা করেছে, কোনো অসুস্থতাকে নিজের ভিতর বাসা বাঁধতে দেবে না। কিছুতেই না। মানুষ অসুস্থ নয় সেটা তাকেই বোঝাতে হবে।
কিন্তু বোম্যান টের পায় তার ব্যবহারে পালা বদলের হাওয়া লাগছে। সে আর নিরবতাকে মেনে নিতে পারে না একপলের জন্যও। ঘুম আর কথা বলার সময় ছাড়া সারাক্ষণ সে ভীষণ জোরে শব্দ করায় শিপের স্পিকারে।
মানুষের শব্দ আর সঙ্গের জন্য প্রথম প্রথম সে শ’[৪৮], ইবসেন[৪৯] আর শেক্সপিয়রের ক্লাসিক নাটক নিয়ে মেতে থাকত। নয়তো ডিসকভারি লাইব্রেরির অসীম কবিতা সংগ্রহের মধ্যে একের পর এক বেজে চলে।
বেশিদিন এ নিয়ে চলা গেল না। সে এবার ঝুঁকে পড়ে অপেরার দিকে। দু-হপ্তা পর সে বোঝে এই অত্যন্ত সাবধানে বাছাই করা শব্দগুলো তার একাকিত্বকে বাড়িয়ে তুলছে। এবার ভার্দির[৫০] রিকুইম মাস এ এসে ঠেকেছে তার তরী। এ জিনিস পৃথিবীতে থাকতে বোম্যান কস্মিনকালেও শোনেনি। মাসের বেহেস্ত থেকে কেয়ামতের ধ্বনি শিপের প্রান্তে প্রান্তে বাজতে থাকলে সে আর সহ্য করতে পারে না।
তারপর শুধু বাজনা। রোমান্টিক ধ্বনি তার মনকে আরো অন্ধকারে ঠেলে দেয়, সঙ্গহীনতার অন্ধকারে। সিবেলিয়াস, শেইকোভস্কি, আর বার্লিওস কয়েক হপ্তা টিকে থাকে। বিথোফেন[৫১] চলে আরো বেশিদিন। সে আরো অনেকেরই মতো সবশেষে থিতু হয় বাঁচে[৫২], মাঝে মধ্যে নাক গলায় মোজার্ট[৫৩]।
এবং ডিসকভারি তার প্রায় অনন্ত যাত্রা শেষ করে শনির কবলে পড়ে।
.
এক কোটি মাইল দূর থেকেই শনি পৃথিবীর আকাশে চাঁদের চেয়ে বড় হয়ে উঁকি দিচ্ছে। খোলা চোখে এ এক মহাকীর্তি, টেলিস্কোপে অবিশ্বাস্য।
প্রথমে বৃহস্পতি বলে ভুল হতেই পারে। প্রায় একই আকারে গ্রহটায় একটু ফ্যাকাসে মেঘের দল একইভাবে উড়ে চলছে-তাদের ঘনত্বটা একটু কম। আকাশে তেমনি মহাদেশীয় ঘূর্ণিঝড়। একটা দিক দিয়ে দুজনের বিস্তর তফাৎ, চোখ রেখেই বোঝা যায়, দুর্বিপাকের প্রতিভূ শনি একেবারে গোলাকার নয়।
কিন্তু শনির বলয় তার চোখকে বারবার টেনে নেয়। তাদের বিশালত্ব, তাদের ব্যাপকতাই এক ভিন্ন সৃষ্টি জগৎ গড়ে দিয়েছে। বাইরের দিকের আর ভিতরের দিকের বলয়গুলোর মধ্যে যে বিশাল ফাঁকা-সেখানেও দেখার মতো অনেক কিছুই আছে। সেখানে নিদেনপক্ষে অর্ধশত উপদৃশ্য দেখা যায়। ঐ স্থানে গ্রহের দানবীয় উজ্জ্বলতা পলে পলে রূপ বদলায়। যেন শনি নানা রকমের এককেন্দ্রিক ফিনফিনে চাকতি গায় দিয়েছে। সবাই ছুঁয়ে যাচ্ছে সবাইকে। সবাই এত পাতলা, যেন সবচে পল্কা কাগজ কেটে তাদের গড়া হয়েছে। এই আঙটি-জগৎটা যেন কোনো অসম্ভব সুন্দর জটিল শিল্পকর্ম। যেন কোনো ভঙ্গুর খেলনা, একে শুধু দেখা যাবে, ছোঁয়া যাবে না। এই বিশালত্ব উপলব্ধির, অনুভবের নয়। বোম্যানের মনে হল পৃথিবীকে এর যে কোনো বলয়ে বসিয়ে দিলে একটা মুক্তার মতো সেটা ঘুরতে থাকবে।
কোনো তারা যদি বলয়গুলোর পেছনে পড়ে যায় তবে সেটার উজ্বলতা সামান্যই ম্লান হবে, এত সূক্ষ্ম এর বুনন। আবার এক আধবার হারিয়েও যেতে পারে ঘূর্ণায়মান ছোট্ট কোনো টুকরার আড়ালে।
মানুষ আদ্যিকাল থেকেই জানে রিংগুলো কঠিন নয়। কারণ যান্ত্রিকভাবে ব্যাপারটা অসম্ভব। এগুলো অতি ছোট টুকরো আর ধূলিকণা। কে জানে কোকালে কোন উপগ্রহ শনির টানে ভেসে এসেছিল, এসে আর তা সইতে পারেনি।
তাদের উৎস যাই হোক না কেন, মানবজাতি এ জিনিস দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। এটা সৌর জগতের সময়ের মানে একপল টিকে থাকতে পারত। কিংবা আসলেই হয়তো এই বলয়গুলোর টিকে থাকার সময় সৌরজাগতিক হিসেবে সামান্য একটা মুহূর্ত ছাড়া কিছু নয়।