এই যুক্তির স্রোত আরেক নতুন বানে ভেসে যায়। এ জীববিদেরা নিজেদেরকে স্পেস এজ বা মহাকাশ যুগের সন্তান এবং সর্বকুসংস্কারমুক্ত বলে মনে করেন। তারা দেখিয়েছেন যে মানবদেহ লক্ষ লক্ষ বিবর্তনিক পরিবর্তন আর বেছে নেয়ার ফল, সময়ের অপার সমুদ্রে এই পরিবর্তন একটু একটু করে এসেছে-এককোষী এ্যামিবা থেকেই এর শুরু। তার লক্ষ যুগ পর একটু বড় জীবাণু, এরপর অযুত সমুদ্র পেরিয়ে তন্ত্র গঠন, আরো লাখ লাখ বছর পর অঙ্গ তৈরি হওয়া, আরো পরে কর্ডেটে পরিণত হওয়া এবং সবশেষে মাম্মালিয়ার পর্যায়ে এসে বানর থেকে মানুষ’-এ পরিণত হতে আরো আধ কোটি বছর সময় লেগেছে। এই লাখো পরিবর্তনের যে কোনো এক মুহূর্তে মানুষের কোটি জিনের জেনেটিক ছাঁচ একটু এদিকসেদিক পড়ে যেতেই পারে; এর ফলে যদি ভালও হয়ে থাকে-নিশ্চয়ই আদর্শ শরীর থেকে একটু হলেও সরে এসেছে মানুষ। তাহলে, মানুষের গঠন যদি মিলিয়ন মিলিয়ন বছরে একটু একটু নড়েচড়ে বসতে বসতে আদর্শ দেহ থেকে অনেকটা দূরে চলে যেতে পারে তাহলে ঐ প্রাণীরা কোনো দোষটা করল? তাদের গড়নও তো আদর্শ হতে পারে, তাহলেও ভিন্ন হবে। আবার আদর্শ থেকে সরে এলেও ভিন্ন হবে।
আর এ গঠনই যে আদর্শ তাই বা বিজ্ঞানীরা ঠিক করে বলেন কী করে? এরচে ভাল গঠনতো তারা দেখেননি। আর যাদের প্রযুক্তি এত ভাল তাদের গঠনও ভাল হবে। আবার মানুষের গড়ন পার্থিব হিসেবে সবচে ভাল, কিন্তু সেই প্রাণীদের গ্রহের জীবন অণু যদি অক্সিজেন কেন্দ্রিক না হয়, তাদের মাধ্যাকর্ষণ যদি অনেক বেশি হয়, খাদ্য যদি সৌরশক্তির হয়…। মানুষের দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজ করতে করতে এগিয়ে এসেছে-তারা তাদের কাজ বদলে নিয়েছে খেয়াল মাফিক, এমনকি অ্যাপেন্ডিক্সের মতো একেবারে অকেজো অদরকারী অংশও মানুষ বহন করছে তার দেহে। সেটা আগে কাজে লাগলে লাগতেও পারত, এখন লাগে না। তাহলে মানবদেহ কী করে সবচেয়ে উপযোগী হয়? আর দেহ কেন্দ্রিক উন্নয়ন ভেবে মস্তিষ্ক কেন্দ্রিক উন্নয়ন হয়ে থাকলেও ঘাপলা বাধবে। বিবর্তন যদি চলে, তাহলে আরো ভাল গড়ন এগিয়ে আসবে। যেমন, হাতের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে হাত হয়ে যাবে কাঠির মতো সরু। সেটা খারাপও হতে পারে। সেসব বিজ্ঞানীর শেষ অস্ত্রটাই ভয়ানক, আরে, কে বলল যে মানুষের বিবর্তন ফুরিয়ে গেছে?
আরো ভাবুক আছে, বোম্যান দেখতে পায়, তাদের দৃষ্টি আরো পাগলাটে। তারা বিশ্বাস করে না যে সত্যিকার অগ্রসর সভ্যতা ঠুনকো জৈবিক দেহ টেনে চলবে। প্রযুক্তি এগিয়ে চলতে থাকলে আজ অথবা কাল, তারা অবশ্যই তাদের প্রকৃতি প্রদত্ত ভঙ্গুর, জরা-দুর্দশা-ক্লেশগ্ৰস্ত আবাস ছেড়ে সবদিক দিয়ে নিরাপদ একটা আশ্রয় খুঁজে নেবে। কেন তারা প্রকৃতির আদেশে বিশ্রী এই বাড়িতে সারা জীবন ঝড় ঝা
পোহাবে? তারচে সেখানে না থাকাই কি ভাল না? হ্যাঁ, এই পাগলাটে তত্ত্ববিদেরা মনে করে সেসব প্রাণী অমর হতেই পারে, শতভাগ যান্ত্রিক হতেই পারে, আবার সামান্য জৈবিক অংশ রেখে বাকীটা বাদ দিতেই পারে। শুধু ব্রেনটা রাখলেই প্রথম পর্যায়ে সব চুকে বুকে যায়, তারপর তারা কেন মরণশীল ব্রেনটাকেও উপড়ে ফেলবে না? তারা সৃষ্টিজগতকে দেখবে তাড়িতিক চোখে, চাখবে ধাতব জিহ্বায়।
তাদের অনুভূতি হবে বৈদ্যুতিক, একটা-মাত্র একটা ইলেক্ট্রন এদিক থেকে ওদিকে গেলে তারা আবেশিত হবে, অনুভব করবে। উন্নত প্রাণী কোনো দুঃখে কোটি কোটি বছরের অন্ধ বিবর্তনের অর্জিত ভোঁতা নীরস জৈবিক নিউরনিক অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিয়ে যাবে? অনুভূতির এই অসীমতা কোনোদিন এনে দিতে পারবে না বোকাটে বিবর্তনবিদ্যা।
এ কাজ করলে প্রকৃতিকে অমান্য করা হয়? বুদ্ধিমান প্রাণী যেদিন গাছ থেকে ফল না পেড়ে নিজে গাছ পুঁতেছে সেদিনই প্রকৃতিকে অমান্য করেছে। হ্যাঁ, বুদ্ধিমান প্রাণীর রোপিত গাছের ধারকও প্রকৃতিই, কিন্তু সভ্য প্রাণী সার দেয় বলে ফলন বেশি-সে হিসাবে তাদের যান্ত্রিক দেহওতো প্রকৃতি থেকেই নেয়া, তারা একটু প্রযুক্তি দেয় বলে সুবিধা বেশি।
আমরা এমন কিছু দেখিনি বলে জগতে এমন কিছু হতে পারে না- এ ভাবনাতো প্রাচীন আর মধ্যযুগের মানুষের ভাবনা। মহাকাশ যুগের মানুষ অনেক বেশি ভাবতে জানে।
এমনকি পৃথিবীতেও এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়ে গেছে। কত শত কোটি মানুষ আগে ধ্বংস হয়ে যেত, তাদেরই মতো অন্যেরা আজ বেঁচে আছে বহাল তবিয়তে। ধন্যবাদ কৃত্রিম কিডনি, হৃদপিণ্ড, যান্ত্রিক হাত-পা কে।
এ প্রক্রিয়া এক সুনির্দিষ্ট জায়গায় গিয়েই থামবে, তা লক্ষ্যটা যত দূরেই হোক।
এমনকি এ প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কও হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে। ঘটনাপরম্পরায় এর প্রয়োজন এক সময় না এক সময় ফুরাবে, ইলেক্ট্রনিক ইন্টেলিজেন্সের উন্নয়ন সে কথারই প্রমাণবাহী। মন আর মেশিনের দ্বন্দ্ব ফুরাবে সেই শেষ সত্যিতে গিয়ে, যেখানে সিমবায়োসিস[৪৭] হবে পূর্ণ…
কিন্তু এই কি শেষ? এখনো দুর্ধর্ষ জীববিজ্ঞানীরা কল্পরথে চড়ে আরো আরো আরো দূরে যেতে যায়। তারা অনেক ধর্মের সারকথা বলে। বলে, মন সরিয়ে দেবে বস্তুকে। কথাটা কতটুকু ধর্মকথা আর তাতে কতটা বিজ্ঞান জড়িত? রোবট বডিতেও থাকবে লাখো সমস্যা। তারা সব করতে পারবে না ইচ্ছামতো। অসীম গতি পাবে না। সব ভেদ করতে পারবে না। অগ্রসর বিজ্ঞান কি তা-ও মেনে নিবে? নাকি তারপরই শুরু হবে নতুন যুগ…আত্মার যুগ?