ঠিক দুপুরে, লাঞ্চের সময় এলেই নিয়ন্ত্রণ হালের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। লাউঞ্জ আর ডাইনিং স্পেসের জন্য এক রুমই বরাদ্দ। সেখানেও হুবহু একই রকম একটা সিচুয়েশন ডিসপ্লে প্যানেল আছে। হাল সারক্ষণ ওর সাথে যোগাযোগ রাখে। পোল তার ছ-ঘণ্টার ঘুমে যাবার আগে তার সাথে যোগ দেয়। এর সাথে প্রায় সব সময়ই থাকে পৃথিবীর বিভিন্ন টিভি প্রোগ্রাম।
মিশনের আর সব দিকের মতো তাদের খাবারের দিকেও সমান যত্ন নেয়া হয়। খাবারের বেশিরভাগই শুকনো। ঠাণ্ডায় জমিয়ে রাখা হয় এগুলোকে। এমন চমৎকার খাবার সৃষ্টিকুলে কেউ হয়তো পায় না; শরীরের সাথে ঠিকমতো খাপ খেয়ে যায়। প্যাকেট খুলে অটো গ্যালিতে ফেলে দিলেই হলো। সময়মতো রান্নাঘর জানিয়ে দেবে, দেখিয়ে দেবে সত্যিকার অরেঞ্জ জুস বা নানা ধরনের ডিম। আর কত ধরনের খাবারের কথা তারা মনে করতে পারে? সবই পাওয়া যাবে।
1300 থেকে 1600 পর্যন্ত শিপ ট্যুর। ডিসকভারি একপাশ থেকে আরেকপাশে প্রায় চারশো ফুট লম্বা। কিন্তু এর ক্রুদের রাজত্ব কেবল চল্লিশ ফুটের প্রেশার শরীরের ভিতর।
এখানে সব ধরনের লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম পাওয়া যায়। কন্ট্রোল ডেক হল শিপের হৃদপিণ্ড। এর নিচে আছে এক ছোট্ট স্পেস গ্যারেজ। ভিতরে তিন দরজা দিয়ে তিনটি অতি ছোট ক্যাপসুল ভেসে বেরিয়ে যেতে পারে। সেগুলো একজন মানুষের চেয়ে বেশি কিছু বয়ে নিতে পারবে না।
ডিসকভারির অক্ষে আছে পঁয়ত্রিশ ফিট ব্যাসের এক ড্রাম। সারাক্ষণ ঘোরে বলেই এখানে সৃষ্টি হয় একটু মাধ্যাকর্ষণ। চাঁদের মতো মাধ্যাকর্ষণ তোলার আশায় জিনিসটা সব সময় দশ সেকেন্ডে একবার ঘুরে চলে। ফলে নিতান্ত ওজনহীনতার ধকল থেকে বেশ ভালোভাবেই বেঁচে যায় ক্রুরা।
কয়রাসেলে আছে বেশ কিছু সুবিধা। কিচেন, ডাইনিং, ওয়াশিং আর টয়লেট রুমগুলো (অথবা বলা ভালো ব্যবস্থাগুলো) এখানে। একমাত্র এখানেই পানি ফুটানো নিরাপদ। অন্য কোথাও সে কাজ করতে গেলে পানির ভাসমান বুদবুদগুলো মহা তেলেসমাতি দেখাবে। দাড়ি কামাতে গিয়ে হাজারো টুকরোকে ভেসে বেড়াতে দেখতে হয় না। প্রান্তসীমা জুড়ে পাঁচটা ছোট্ট কিউবিকলে পাঁচ অভিযাত্রীর একমাত্র আপন ভুবন। তাদের মালসামানও সেখানেই থাকে। বর্তমানে মাত্র দুটি কিউবিক কাজে লাগছে।
প্রয়োজনে করোসেলের ঘূর্ণন থামানো যায়। সেক্ষেত্রে কৌণিক ভরবেগটা চলে যাবে একটা ফ্লাই হুইলে। কিন্তু থামানো হয় না কারণ এই ড্রামের ভিতর ঢোকা, সহজ। মই বেয়ে উঠতে হয়, সেখানে কোনো মাধ্যাকর্ষণ নেই। একটু চর্চা থাকলেই ব্যাপারটা কোনো চলন্ত এসকেলেটরে চড়ার মতো স্বয়ংক্রিয় হয়ে যায়।
আর শিপের লম্বাটে অংশটা চিকণ, তীরের মতো দেখতে। আর সব গভীর মহাশূন্যযানের মতো ডিসকভারিও মহা ভঙ্গুর বস্তু। এটা কোনো গ্রহের আকর্ষণ ক্ষেত্রেই প্রবেশ করতে পারবে না।
সে গঠিত হয়েছে পৃথিবীর অর্বিটে, তার পরীক্ষা হয়েছে একটু বাইরের দিকে, তার উৎক্ষেপণ হয়েছে চাঁদের বাইরের কক্ষপথে। সুতরাং সে মহাশূন্যের একেবারে খাঁটি সন্তান।
এই গোল মনুষ্য-এলাকার ঠিক বাইরেই রয়েছে চারটা বিরাট ট্যাঙ্ক। সেগুলো তরল হাইড্রোজেনে পূর্ণ। ট্যাঙ্কের পেছনেই এক মস্ত ভি অক্ষর, যেটা নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর থেকে বেরুনো বাদবাকি তেজস্ক্রিয়তা শুষে নেয়। এরপর রিয়্যাক্টর ঠাণ্ডা করার জন্য যে তরল প্রবাহিত হয় তার এক বিশাল, প্যাচানো লেজ। একে খুব সুন্দরভাবেই কোনো গঙ্গাফড়িংয়ের লেজের সাথে তুলনা করা যায়। এদিক দিয়ে ডিসকভারি যেন খানিকটা পুরনো দিনের জাহাজ।
ডি এর একদম শেষ মাথায় লুকানো আছে সেই প্রাণভোমরা, পারমাণবিক চুল্লী। এলাকাটা ক্রুদের কেবিন থেকে তিনশ ফুট পেছনে। এখানে আছে বেশ কিছু ফুয়েল রড, সেই রড ধারণ করে নক্ষত্র-অমৃত। প্লাজমা সৃষ্টি হয়, চলে যায় প্লাজমা ড্রাইভে। এর কাজ বহু হপ্তা আগেই ফুরিয়ে গেছে, সে ডিসকভারিকে চাঁদের পার্কিং অর্বিট থেকে ঠেলে বের করে দিয়েছে সাফল্যের সাথে। এখন প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ যোগান দেয়ার জন্য টিমটিম করে জ্বলছে এই চুল্লী। ভিটা এখন কালো আর ঠাণ্ডা। এটাই একেবারে গনগনে লাল হয়ে যায় পূর্ণ শক্তিতে প্লাজমা ইঞ্জিন চলা শুরু করার পর।
শিপের এসব এলাকায় যাবার কথা কস্মিনকালেও কেউ ভাবে না। এজন্য সদা সতর্ক থাকে রিমোট টিভি ক্যামেরাগুলো। বোম্যান ভালো করেই জানে যে সে প্রতি ইঞ্চি এলাকা চোখ বন্ধ করে বর্ণনা করতে পারবে।
1600’র মধ্যে কাজ শেষ করে মিশন কন্ট্রোলের জন্য রিপোর্ট পাঠাতে হয়। জবাব আসার পর নিজের ট্রান্সমিশন বন্ধ করে 1800 টায় পোলের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করার প্রস্তুতি নেবে।
তারা ডিউটির বাইরে ছঘন্টা সময় পায়। যা ইচ্ছা করে বেড়ানোর সেটাই আসল সময়। এর বেশিরভাগ কেটে যায় জাহাজের ইলেক্ট্রনিক লাইব্রেরিতে। বোম্যান সব সময় অতীতের বিশাল অভিযানগুলোর রোমাঞ্চ নিজের ভিতর অনুভব করে, সময়ের অনুপাতে সেসবের দূরত্বও ছিল কম। আজ সে স্বয়ং সবচে দূরবর্তী অভিযাত্রার যাত্রী।
কখনো বা সে হারকিউলিসের পিলার ছাড়িয়ে পাইথিয়াসে[৩৫] যাত্রা করতে উৎসাহী হয়। প্রস্তর যুগ থেকে মাথা ভাসানো আফ্রিকাকে সাগর তীর ধরে দেখার তার অদম্য স্পৃহা দেখার আশা জাগে দুই মেরু। অথবা দুহাজার বছর ফারাকে চলে গিয়ে সে ম্যানিলা গ্যালিয়ন[৩৬]গুলোতে চড়ে বেড়াতে চায় এ্যানসনকে সাথে নিয়ে। অথবা কুককে[৩৭] সঙ্গী করে পাল তুলে দিতে চায় শিহরণ ভোলা অস্ট্রেলীয় গ্রেট বেরিয়ার রিফের এলাকায়। সে ওডিসি[৩৮] পড়াও শুরু করেছে। সময় সাগর পাড়ি দিয়ে এই মহাকাব্যই তাকে বিস্ময়স্তম্ভিত করে রাখে।