যে অস্ত্ৰে বুর্জোয়া শ্রেণী সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধূলিসাৎ করেছিল। সেই অস্ত্র আজ তাদেরই বিরুদ্ধে উদ্যত।
যে অস্ত্রে তাদের মৃত্যু বুর্জোয়া শ্রেণী শুধু সে অস্ত্রটুকুই গড়েনি; এমন লোকও তারা সৃষ্টি করেছে যারা সে অস্ত্র ধারণ করবে, সৃষ্টি করেছে আধুনিক শ্রমিক শ্রেণীকে, প্রলেতারিয়েতকে।
যে পরিমাণে বুর্জোয়া শ্রেণী অর্থাৎ পুঁজি বেড়ে চলে ঠিক সেই অনুপাতে বিকাশ পায় প্রলেতারিয়েত অর্থাৎ আধুনিক শ্রমিক শ্রেণী, মেহনতীদের এ শ্রেণীটি বাঁচতে পারে যতক্ষণ কাজ জোটে, আর কাজ জোটে শুধু ততক্ষণ যতক্ষণ তাদের পরিশ্রমে পুঁজি বাড়তে থাকে। এই মেহনতীদের নিজেদের টুকরো টুকরো করে বেঁচতে হয়। বাণিজ্যের অন্য সামগ্রীর মতোই তারা পণ্যদ্রব্যের সামিল। আর সেই হেতু নিয়তই প্রতিযোগিতার সবকিছু ঝড় ঝাপটা, বাজারের সবরকম ওঠানামার অধীন তারা।
যন্ত্রের বহল ব্যবহার এবং শ্রমবিভাগের ফলে প্রলেতারিয়েতের কাজ আজ সকল ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে, এবং সেই হেতু মাজরের কাছে কাজের আকর্ষণ লোপ পেয়েছে। মজার হয়েছে যন্ত্রের লেজুড়, তার কাছে চাওয়া হয় অতি সরল, একান্ত একঘেয়ে, অতি সহজে অর্জনীয় যোগ্যতাটুকু। সুতরাং মকুরের উৎপাদন খরচটাও সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে প্রায় একান্তই তাকে বাঁচিয়ে রাখার ও তার বংশরক্ষার পক্ষে অপরিহার্য অন্নবস্ত্রের সংস্থানটুকুর মধ্যে। কিন্তু পণ্যের দাম, অতএব শ্রমেরও দাম(5) তার উৎপাদন খরচার সমান। সুতরাং কাজের জঘন্যতা যত বাড়ে, মজুরি তত কমে। শুধু তাই নয়, যে পরিমাণে যন্ত্রের ব্যবহার ও শ্রমবিভাগ বাড়ে, সেই অনুপাতে বাড়ে কাজের চাপ, হয় খাটুনির ঘণ্টা বাড়িয়ে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই বেশি কাজ আদায় করে, অথবা যন্ত্রের গতিবেগ বাড়িয়ে দিয়ে, ইত্যাদি।
আধুনিক যন্ত্রশিল্প পিতৃতান্ত্রিক মালিকের ছোট কর্মশালাকে শিল্প-পুঁজিপতির বিরাট ফ্যাক্টরিতে পরিণত করেছে। বিপুল সংখ্যায় মজুরকে ফ্যাক্টরির মধ্যে ঢোকান হয় ভিড় করে, সংগঠিত করা হয় সৈনিকের ধরনে। শিল্পবাহিনীর সাধারণ সৈন্য হিসাবে তারা থাকে অফিসার সার্জেণ্টদের এক খাঁটি বহুধাপী ব্যবস্থার অধীনে। মজুরেরা কেবলমাত্র বুর্জোয়া শ্রেণীর ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রের দাস নয়; দিনে দিনে ক্ষণে ক্ষণে তাদের করা হচ্ছে যন্ত্রের দাস, পরিদর্শকের দাস, সর্বোপরি খাস বুর্জোয়া মালিকাটির দাস। এই যথেচ্ছাচার যত খোলাখালিভাবে মুনাফালাভকেই নিজের লক্ষ্য ও আদর্শ হিসাবে ঘোষণা করে ততই তা হয়ে ওঠে আরও হীন, আরও ঘৃণ্য, আরও তিক্ত।
শারীরিক মেহনতে দক্ষতা ও শক্তি যতই কম লাগতে থাকে, অর্থাৎ আধুনিক যন্ত্রশল্প যতই বিকশিত হয়ে ওঠে, ততই পুরুষের পরিশ্রমের স্থান জুড়ে বসতে থাকে নারী শ্রম। শ্রমিক শ্রেণীর কাছে বয়স কিংবা নারী-পুরুষের তফাতটার এখন আর বিশেষ সামাজিক তাৎপৰ্য নেই। সকলেই তারা খাটবার যন্ত্ৰমাত্র; বয়স অথবা স্ত্রী-পুরুষের তফাত অনসারে সে যন্ত্র ব্যবহারের খরচাটুকু কিছু বাড়ে-কমে মাত্র।
শিল্পের মালিক কর্তৃক মজুরের শোষণ খানিকটা সম্পূর্ণ হওয়া মাত্র অর্থাৎ তার মজুরির টাকাটা পাওয়া মাত্র, তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বুর্জোয়া শ্রেণীর অন্যান্য অংশ–বাড়িওয়ালা, দোকানদার, মহাজন প্রভৃতি।
মধ্য শ্রেণীর নিম্ন স্তর–ছোটখাট ব্যবসায়ী, দোকানদার, সাধারণত ভূতপূর্ব কারবারীরা সবাই, হস্তশিল্পী এবং চাষীরা–তারা ধীরে ধীরে প্রলেতারিয়েতের মধ্যে নেমে আসে। তার এক কারণ, যতখানি বড় আয়তনে আধুনিক শিল্প চালাতে হয় এদের সামান্য পুঁজি তার পক্ষে যথেষ্ট নয় এবং প্রতিযোগিতায় বড় পুঁজিপতিরা এদের গ্লাস করে ফেলে; অপর কারণ, উৎপাদনের নতুন পদ্ধতির ফলে এদের বিশিষ্ট নৈপুণ্যটুকু অকেজো হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং প্রলেতারিয়েতের পুষ্টিলাভ হতে থাকে জনগণের প্রতিটি শ্রেণী থেকে আগত লোকের দ্বারা।
বিকাশের নানা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে প্রলেতারিয়েতকে যেতে হয়। বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে এর সংগ্রাম শুরু হয় জন্ম মুহূর্ত থেকে। প্রথমটা লড়াই চালায় বিশেষ বিশেষ মজুরেরা; তারপর লড়তে থাকে গোটা ফ্যাক্টরির মেহনতীরা; তারপর কোনও একটা অঞ্চলের একই পেশায় নিযুক্ত সকল শ্রমিকরা তাদের সাক্ষাৎ শোষণকারী বিশিষ্ট পুঁজিপতিটির বিরুদ্ধে লড়ে। তাদের আক্রমণের লক্ষ্য হয় উৎপাদনের উপকরণ, উৎপাদনের বুর্জোয়া ব্যবস্থাটা নয়; যে আমদানি মাল তাদের মেহনতের প্রতিযোগিতা করে সেগুলি তারা ধ্বংস করে, কল ভেঙে চুরমার করে দেয়, কারখানায় আগুন লাগায়, মধ্যযুগের মেহনতকারীর যে মর্যাদা লোপ পেয়েছে, গায়ের জোরে চায় তা ফিরিয়ে আনতে।
এই পর্যায়ে মজুরেরা তখনও দেশময় ছড়ানো এলোমেলো জনতামাত্র, পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় ছত্রভঙ্গ। কোথাও যদি তারা অধিকতর সংহত সংস্থায় একজোটও হয়, তব সেটা তখনও নিজস্ব সক্রিয় সম্মিলনের ফল নয়, বরং বুর্জোয়া শ্রেণীর সম্মিলনের ফলমাত্র। এ শ্রেণী নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য গোটা প্রলেতারিয়েতকে সচল করতে বাধ্য হয়, তখনও কিছু দিনের জন্য সে চেষ্টায় সফলও হয়। সুতরাং এই পর্যায়ে মজুরেরা লড়ে নিজেদের শত্রুর বিপক্ষে নয়, শত্রুর শত্রু, অর্থাৎ নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের অবশিষ্টাংশ, জমিদার, শিল্প বহির্ভূত বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়াদের বিরদ্ধে। এ অবস্থায় ইতিহাসের সমস্ত গতিটি বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতের মুঠোর মধ্যে থাকে; এভাবে অর্জিত প্রতিটি জয় হল বুর্জোয়ার জয়।