সকল উৎপাদন-যন্ত্রের দ্রুত উন্নতি ঘটিয়ে যোগাযোগের অতি সংবিধাজনক উপায় মারফত বুর্জোয়ারা সভ্যতায় টেনে আনছে সমস্ত, এমন কি অসভ্যতম জাতিকেও। যে জগদ্দল কামান দেগে সে সমস্ত চীনা-প্রাচীর চূর্ণ করে, অসভ্য জাতিদের অতি একরোখা বিজাতি-বিদ্বেষকে বাধ্য করে আত্মসমর্পণে তা হল তার পণ্যের শস্তা দর। সকল জাতিকে সে বাধ্য করে বুর্জোয়া উৎপাদন-পদ্ধতি গ্রহণে, অন্যথায় বিলপ্ত হয়ে যাবার ভয় থাকে; বাধ্য করে সেই বস্তু গ্রহণে যাকে সে বলে সভ্যতা- অর্থাৎ বাধ্য করে তাদেরও বুর্জোয়া বনতে। এককথায়, বুর্জোয়া শ্রেণী নিজের ছাঁচে জগৎ গড়ে তোলে।
গ্রামাঞ্চলকে বুর্জোয়া শ্রেণী শহরের পদানত করেছে। সৃষ্টি করেছে বিরাট বিরাট শহর, গ্রামের তুলনায় শহরের জনসংখ্যা বাড়িয়েছে প্রচুর, এবং এইভাবে জনগণের এক বিশাল অংশকে বাঁচিয়েছে গ্রামজীবনের মূঢ়তা থেকে। গ্রামাঞ্চলকে এরা যেমন শহরের মুখাপেক্ষী করে তুলেছে, ঠিক তেমনই বর্বর বা অর্ধবর্বর দেশগুলিকে করেছে সভ্য দেশের উপর, চাষীবহল জাতিকে করেছে বুর্জোয়া-প্রধান জাতির, পূর্বাঞ্চলকে পশ্চিমের উপর নির্ভরশীল।
অধিবাসীদের, উৎপাদন উপায়ের এবং সম্পত্তির বিক্ষিপ্ত অবস্থাটা বুর্জোয়া শ্রেণী ক্রমশই ঘুঁচিয়ে দিতে থাকে। জনসংখ্যাকে এরা পঞ্জীভূত করেছে, উৎপাদনের উপায়গুলি করেছে কেন্দ্রীভূত, সম্পত্তিকে জড়ো করেছে অল্প লোকের হাতে। এরই অবশ্যম্ভাবী ফল হল রাজনৈতিক কেন্দ্রীভবন। বিভিন্ন ধরনের স্বার্থ, আইনকানুন, শাসনব্যবস্থা অথবা করপ্রথা সম্বলিত স্বাধীন কিংবা শিথিলভাবে সংযুক্ত প্রদেশগুলিকে ঠেসে মেলানো হয় এক একটা জাতিতে যাদের একই শাসনযন্ত্র, একই আইন সংহিতা, একই জাতীয় শ্রেণী-দ্বাৰ্থ, একই সীমান্ত, এবং একই শুল্ক-ব্যবস্থা।
আধিপত্যের এক শতাব্দী পূর্ণ হতে না হতে, বুর্জোয়া শ্রেণী যে উৎপাদন শক্তির সৃষ্টি করেছে তা অতীতের সকল যুগের সমষ্টিগত উৎপাদন-শক্তির চেয়েও বিশাল ও অতিকায়। প্রকৃতির শক্তিকে মানুষের কর্তৃত্বাধীন করা, যন্ত্রের ব্যবহার, শিল্প ও কৃষিতে রসায়নের প্রয়োগ, বাষ্পশক্তির সাহায্যে জলযাত্রা, রেলপথ, ইলেকট্ৰিক টেলিগ্রাফ, চাষবাসের জন্য গোটা মহাদেশ সাফ করে ফেলা, জলযাত্রার জন্য নদীর খাত কাটা, ভেলকিবাজির মতো যেন মাটি ফুড়ে জনসমষ্টির আবির্ভাব–সামাজিক শ্রমের কোলে যে এতখানি উৎপাদন-শক্তি সুপ্ত ছিল, আগেকার কোন শতক তার কল্পনাটুকুও করতে পেরেছিল?
তাই দেখা যাচ্ছে যে উৎপাদন ও বিনিময়ের যে সব উপায়কে ভিত্তি করে বুর্জোয়া শ্রেণী নিজেদের গড়ে তুলেছে, তাদের উৎপত্তি সামন্ত সমাজের মধ্যে। উৎপাদন ও বিনিময়ের এই সব উপায় বিকাশের একটা বিশেষ পর্যায়ে এল যখন সামন্ত সমাজের উৎপাদন ও বিনিময়ের শত, সামন্ত কৃষি ও হস্তশল্প কারখানার সংগঠন, এককথায় মালিকানার সামন্ত সম্পর্ক গুলি আর কিছুতেই বিকশিত উৎপাদন-শক্তির সঙ্গে খাপ খেল না। এগুলি তখন শৃঙ্খল হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে শৃঙ্খল ভাঙতে হত এবং তা ভেঙে ফেলা হল।
তাদের জায়গায় এগিয়ে এল অবাধ প্ৰতিযোগিতা, সেই সঙ্গে তারই উপযোগী সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব।
আমাদের চোখের সামনে আজ অন্যরূপে আর এক ধারা চলেছে। নিজের উৎপাদনসম্পর্ক, বিনিময়-সম্পর্ক ও সম্পত্তি-সম্পর্ক সহ আধুনিক বুর্জোয়া সমাজ–ভেলকিবাজির মতো উৎপাদনের এবং বিনিময়ের এমন বিশাল উপায় গড়ে তুলেছে যে সমাজ, তার অবস্থা আজ সেই যাদুকরের মতো যে মন্ত্রবলে পাতালপুরীর শক্তিসমূহকে জাগিয়ে তুলে আর সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। গত বহু দশক ধরে শিল্প বাণিজ্যের ইতিহাস হল শুধু বর্তমান উৎপাদন-সম্পকের বিরুদ্ধে, বুর্জোয়া শ্রেণীর অস্তিত্ব ও আধিপত্যের যা মূলশর্ত সেই মালিকানা সম্পর্কের বিরুদ্ধে আধুনিক উৎপাদন-শক্তির বিদ্রোহের ইতিহাস। যে বাণিজ্য-সংকট পালা করে ফিরে ফিরে এসে প্রতিবার আরো বেশি করে গোটা বুর্জোয়া সমাজের অস্তিত্বটাকেই বিপন্ন করে ফেলে, তার উল্লেখই যথেষ্ট। এইসব সংকটে শোধ যে উপস্থিত উৎপন্নের অনেকখানি নষ্ট হয়ে যায়। তাই নয়, আগেকার সৃষ্ট উৎপাদন-শক্তির অনেকটাও এতে পৰ্যায়ক্রমে ধ্বংস পায়। এইসব সংকটের ফলে এমনই এক মহামারী হাজির হয়। অতীতের সকল যুগে যা অসম্ভব গণ্য করা হত — অতি উৎপাদনের মহামারী। হঠাৎ সমাজ যেন এক সাময়িক বর্বরতার পর্যায়ে ফিরে যায়; মনে হয় যেন বা এক দুর্ভিক্ষে, এক সর্বব্যাপী ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে বন্ধ হয়ে গেল জীবনধারণের সমস্ত উপায়-সরবরাহের পথ, শিল্প বাণিজ্য যেন নষ্ট হয়ে গেল; কী কারণে? কারণ, সভ্যতার পরাকাষ্ঠা হয়েছে, জীবনধারণ সামগ্রীতে দেখা দিয়েছে অতিপ্রাচুর্য, অনেক বেশি হয়ে গেছে শিল্প, অনেক বেশি বাণিজ্য। সমাজের হাতে যত উৎপাদন-শক্তি আছে, বুর্জোয়া মালিকানার শত বিকাশে তা আর সাহায্য করছে না; বরং এই যে শর্তে সে শক্তি শৃঙ্খলিত ছিল তার তুলনায় এ শক্তি হয়ে উঠেছে অনেক বেশি প্রবল; শৃঙ্খলের বাধা তা কাটিয়ে ওঠা মাত্র সমস্ত বুর্জোয়া সমাজে এনে ফেলে বিশৃঙ্খলতা, বিপন্ন করে বুর্জোয়া মালিকানার অস্তিত্ব। বুর্জোয়া সমাজ যে সম্পদ উৎপন্ন করে তাকে ধারণ করার পক্ষে বুর্জোয়া সমাজের অবস্থা বড়ুই সংকীর্ণ। এই সংকট থেকে বুর্জোয়া শ্রেণী আবার কোন উপায়ে নিস্তার পায়? একদিকে, উৎপাদন-শক্তির বিপুল অংশ বাধ্য হয়ে নষ্ট করে ফেলে, অপরদিকে নতুন বাজার দখল করে এবং পুরানো বাজারের পণতর শোষণে। অর্থাৎ বলা যায় যে আরও ব্যাপক আরও ধ্বংসাত্মক সংকটের পথে, সংকট এড়াবার যা উপায় তাকেই কমিয়ে এনে।