নিজের চোখে তা দেখবার জন্য মার্কস যদি এখনও আমার পাশে থাকতেন!
ফ্রেডারিক এঙ্গেলস
লণ্ডন, ১লা মে, ১৮৯o
———–
1) লাসাল আমাদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে সর্বদাই স্বীকার করতেন যে তিনি মার্কসের ‘শিষ্য’ এবং সেই হিসাবে ‘ইশতেহারই’ তাঁর মতের ভিত্তি। তাঁর যে ভক্তরা রাষ্ট্ৰীয় ক্রেডিটের সাহায্যে উৎপাদক সমবাদ্য সম্বন্ধে তাঁর দাবির চেয়ে এগিয়ে যেতে চায়নি, যারা গোটা শ্রমিক শ্রেণীকে রাষ্ট্রীয় সাহায্যের সমর্থক এবং স্বাবলম্বনের সমর্থক এই দুই ভাগে ভাগ করতে চাইত, তাদের কথা অবশ্য সসম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। (এঙ্গেলসের টীকা।)
2) কাল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, রচনা-সংকলন, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় অংশ দ্রষ্টব্য।– সম্পাদক
১. বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত
কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার
ইউরোপ ভূত দেখছে–কমিউনিজমের ভূত। এ ভূত ঝেড়ে ফেলার জন্য এক পবিত্র জোটের মধ্যে এসে ঢুকেছে। সাবেকী ইউরোপের সকল শক্তি — পোপ এবং জার, মেত্তেরনিখ ও গিজো, ফরাসী র্যাডিকালেরা আর জার্মান পুলিশগোয়েন্দারা।
এমন কোন বিরোধী পার্টি আছে, ক্ষমতায় আসীন প্রতিপক্ষ যাকে কমিউনিস্টভাবাপন্ন বলে নিন্দা করেনি? এমন বিরোধী পাটিই বা কোথায় যে নিজেও আরও অগ্রসর বিরোধী দলগুলির, তথা প্রতিক্রিয়াশীল বিপক্ষদের বিরদ্ধে পালটা ছুঁড়ে মারেনি কমিউনিজমের গালি?
এই তথ্য থেকে দটি ব্যাপার বেরিয়ে আসে।
এক। ইউরোপের সকল শক্তি ইতিমধ্যেই কমিউনিজমকে একটা শক্তি হিসাবে স্বীকার করেছে।
দই। সময় এসে গেছে যখন প্রকাশ্যে, সারা জগতের সম্মখে কমিউনিস্টদের ঘোষণা করা উচিত তাদের মতামত কী, লক্ষ্য কী, তাদের ঝোঁক কোন দিকে, এবং কমিউনিজমের ভূতের এই আষাঢ়ে গল্পের জবাব দেওয়া উচিত পার্টির একটা ইশতেহার দিয়েই।
এই উদ্দেশ্য নিয়ে নানা জাতির কমিউনিস্টরা লণ্ডনে সমবেত হয়ে নিম্নলিখিত ‘ইশতেহারটি’ প্রস্তুত করেছে; ইংরেজী, ফরাসী, জার্মান, ইতালীয়, ফ্লেমিশ এবং ডেনিশ ভাষায় এটি প্রকাশিত হবে।
০১. বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত (1)
আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাস শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস।(2)
স্বাধীন মানুষ ও দাস, প্যাট্রিশিয়ান এবং প্লিবিয়ান, জমিদার ও ভূমিদাস, গিল্ড্-কর্তা(3) আর কারিগর, এক কথায় অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত শ্রেণী সর্বদাই পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে থেকেছে, অবিরাম লড়াই চালিয়েছে, কখনও আড়ালে কখনও বা প্রকাশ্যে; প্রতিবার এ লড়াই শেষ হয়েছে গোটা সমাজের বিপ্লবী পুনর্গঠনে অথবা দ্বন্দ্বরত শ্রেণীগুলির সকলের ধ্বংসপ্রাপ্তিতে।
ভূতপূর্ব ঐতিহাসিক যুগগুলিতে প্রায় সর্বত্র আমরা দেখি সমাজে বিভিন্ন বর্গের একটা জটিল বিন্যাস, সামাজিক পদমর্যাদার নানাবিধ ধাপ। প্রাচীন রোমে ছিল প্যাট্রিশিয়ান, যোদ্ধা (knights), প্লিবিয়ান এবং ক্রীতদাসেরা; মধ্যযুগে ছিল সামন্ত প্ৰভু, অনু-সামন্ত (vassals), গিল্ড্-কর্তা, কারিগর, শিক্ষানবিশ কারিগর এবং ভূমিদাস। এইসব শ্রেণীর প্রায় প্রত্যেকটির মধ্যে আবার আভ্যন্তরীণ স্তরভেদ।
সামন্ত সমাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে আধুনিক যে বুর্জোয়া সমাজ জন্ম নিয়েছে তার মধ্যে শ্রেণীবিরোধ শেষ হয়ে যায়নি। এ সমাজ শুধু প্রতিষ্ঠা করেছে নতুন শ্রেণী, অত্যাচারের নতুন অবস্থা, পুরাতনের বদলে সংগ্রামের নতুন ধরন।
আমাদের যুগ অর্থাৎ বুর্জোয়া যুগের কিন্তু এই একটা স্বতন্ত্র বৈশিস্ট্য আছে: শ্রেণীবিরোধ এতে সরল হয়ে এসেছে। গোটা সমাজ ত্রুমেই দুটি বিশাল শত্রুশিবিরে ভাগ হয়ে পড়ছে, ভাগ হচ্ছে পরস্পরের সম্মুখীন দুই বিরাট শ্রেণীতে–বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত।
মধ্যযুগের ভূমিদাসদের ভিতর থেকে প্রথম শহরগুলির স্বাধীন নাগরিকদের (chartered burghers) উদ্ভব হয়। এই নাগরিকদের মধ্য থেকে আবার বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রথম উপাদানগুলি বিকশিত হল।
আমেরিকা আবিষ্কার ও আফ্রিকা প্ৰদক্ষিণে উঠতি বুর্জোয়াদের সামনে নতুন দিগন্ত খুলে গেল। পূর্ব ভারত ও চীনের বাজার, আমেরিকায় উপনিবেশস্থাপন, উপনিবেশের সঙ্গে বাণিজ্য বিনিময় ব্যবস্থার তথা সাধারণভাবে পণ্যের প্রসার বাণিজ্যে নৌযাত্রায় শিল্পে দান করে অভূতপূর্ব একটা উদ্যোগ এবং তদ্দ্বারা টলায়মান সামন্ত সমাজের অভ্যন্তরস্থ বিপ্লবী অংশগুলির জন্য এনে দেয় দ্রুত একটা বিকাশ।
সামন্ত শিল্প-ব্যবস্থায় শিল্পোৎপাদনের একচেটিয়া ছিল গণ্ডিবদ্ধ গিল্ড্গুলির হাতে, নতুন বাজারের চাহিদার পক্ষে তা আর পর্যাপ্ত নয়। তার জায়গায় এল। হস্তশিল্প কারখানা। কারখানাজীবী মধ্য শ্রেণী ঠেলে সরিয়ে দিল গিল্ড্-কর্তাদের। বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট গিল্ডের মধ্যেকার শ্রমবিভাগ মিলিয়ে গেল একই কারখানার ভেতরকার শ্রমবিভাগের সামনে।
এদিকে বাজার বাড়তেই থাকে, চাহিদা বাড়তে থাকে। হস্তশিল্প কারখানাতেও আর কুলাল না। অতঃপর বাষ্প ও কলের যন্ত্রে বিপ্লবী পরিবর্তন ঘটল শিল্পোৎপাদনে। হস্তশিল্প কারখানার জায়গা নিল অতিকায় আধুনিক শিল্প, শিল্পজীবী মধ্য শ্রেণীর জায়গা নিল শিল্পজীবী লাখোপতি, এক একটা গোটা শিল্প বাহিনীর হর্তাকর্তা, আধুনিক বুর্জোয়া।
আমেরিকা আবিষ্কার যার পথ পরিষ্কার করে, সেই বিশ্ববাজার প্রতিষ্ঠা করেছে আধুনিক শিল্প। এ বাজারের ফলে বাণিজ্য, নৌযাত্রা, স্থলপথ যোগাযোগের প্রভূত বিকাশ ঘটেছে। সে বিকাশ আবার প্রভাবিত করেছে শিল্প প্রসারকে, এবং যে অনুপাতে শিল্প, বাণিজ্য, নৌযাত্রা ও রেলপথের প্রসার, সেই অনুপাতেই বিকশিত হয়েছে বুর্জোয়া, বাড়িয়ে তুলেছে তার পুঁজি, মধ্যযুগ থেকে আগত সমস্ত শ্রেণীকেই পেছনে ঠেলে দিয়েছে।