শাসক শ্রেণীদের ক্ষমতার উপর নতুন আক্রমণের পক্ষে পর্যাপ্ত শক্তি যখন ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণী আবার সংগ্রহ করতে পারল তখন আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের সমিতির উদয় হয়। তার লক্ষ্য ছিল ইউরোপ ও আমেরিকার গোটা জঙ্গী শ্রমিক শ্ৰেণীকে একটি বিরাট বাহিনীতে সুসংহত করা। সুতরাং ইশতেহারে লিপিবদ্ধ নীতি থেকে তা শহর হতে পারে না। এমন কর্মসূচি তাকে নিতে হয় যা ইংরেজ ট্রেড ইউনিয়ন, ফরাসী, বেলজীয়, ইতালীয় ও স্পেনীয় প্রুধোঁবাদী এবং জার্মান লাসালপন্থীদের(1) কাছে যেন দরজা বন্ধ না করে। এই কর্মসূচি–আন্তর্জাতিকের নিয়মাবলীর মুখবন্ধ(2) মার্কস রচনা করলেন এমন নিপুণ হাতে যে বাকুনিন ও নৈরাজ্যবাদীরা পর্যন্ত তা স্বীকার করে। ‘ইশতেহারে’ বর্ণিত নীতিগুলির শেষপর্যন্ত বিজয়ী হবার ব্যাপারে মার্কস পুরোপুরি ও একান্তভাবে নির্ভর করেছিলেন শ্রমিক শ্রেণীর বৃদ্ধিগত বিকাশের উপর, মিলিত লড়াই ও আলোচনা থেকে যার উদ্ভব অনিবার্য। পুঁজির সঙ্গে লড়াই-এর নানা ঘটনা ও বিপৰ্যয়, সাফল্যের চাইতে পরাজয়ই বেশি করে, সংগ্রামীদের কাছে প্রমাণ না করে পারে না যে তাদের আগেকার সবরোগহর দাওয়াইগুলি অকেজো, শ্রমিকদের মুক্তির সঠিক শত গলির সম্যক উপলব্ধির পক্ষে তাদের মনকে তৈরি না করে পারে না। মার্কস ঠিকই বঝেছিলেন। ১৮৬৪ সালে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠার সময়কার শ্রমিক শ্রেণীর তুলনায় ১৮৭৪ সালে আন্তর্জাতিক উঠে যাবার সময়কার শ্রমিক শ্রেণী সম্পৰ্ণে অন্যরকম হয়ে ওঠে। ল্যাটিন দেশগলিতে প্রুধোঁবাদ ও জার্মানির স্বকীয় লাসালপন্থা তখন মরণোন্মুখ; এমন কি চরম রক্ষণশীল ইংরেজ ট্রেড ইউনিয়নগুলি পর্যন্ত ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছিল এমন একটা পৰ্যায়ে যখন ১৮৮৭ সালে তাদের সোয়ানসি কংগ্রেসের সভাপতি তাদের তরফ থেকে বলতে পারলেন যে: ‘ইউরোপীয় ভূখন্ডের সমাজতন্ত্র আমাদের কাছে আর বিভীষিকা নেই।‘ অথচ ১৮৮৭ সালের ইউরোপীয় ভূখন্ডের সমাজতন্ত্র প্রায় পুরোপুরিই ‘ইশতেহারে’ ঘোষিত তত্ত্ব মাত্র। সুতরাং কিছুটা পরিমাণে ‘ইশতেহারের’ ইতিহাসে ১৮৪৮ সালের পরবর্তী আধুনিক শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের ইতিহাসটাই প্রতিফলিত। বর্তমানে সমগ্র সমাজতন্ত্রী সাহিত্যের মধ্যে এটি নিঃসন্দেহেই সবচেয়ে বেশি প্রচারিত, সর্বাধিক আন্তর্জাতিক সৃষ্টি, সাইবেরিয়া থেকে কালিফোর্নিয়া পর্যন্ত সকল দেশে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের সাধারণ কর্মসূচি হয়ে দাঁড়িয়েছে তা।
তবুও প্রথম প্রকাশের সময় আমরা একে সমাজতন্ত্রী ‘ইশতেহার’ বলতে পারতাম না। ১৮৪৭ সালে দাই ধরনের লোককে সমাজতন্ত্রী গণ্য করা হত। একদিকে ছিল বিভিন্ন ইউটোপীয় মতবাদের সমর্থকেরা, বিশেষ করে ইংলন্ডে ওয়েন-পন্থী ও ফ্রান্সে ফুরিয়ে-পন্থীরা, অবশ্য ততদিনে উভয়েই সংকীর্ণ গোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছিল। অন্যদিকে ছিল অশেষ প্রকারের সামাজিক হাতুড়ে যারা সামাজিক অবিচার দূর করতে চাইত নানাবিধ সর্বরোগহর দাওয়াই ও জোড়াতালি প্রয়োগ করে–পুঁজি ও মুনাফার বিন্দমাত্র ক্ষতি না করে। উভয় ক্ষেত্রেই এরা ছিল শ্রমিক আন্দোলনের বাইরের লোক এবং সমর্থনের জন্য তাকিয়ে ছিল বরং ‘শিক্ষিত’ সম্প্রদায়ের দিকে। নিতান্ত রাজনৈতিক বিপ্লব যথেস্ট নয় এবিষয়ে স্থিরনিশ্চয় হয়ে শ্রমিক শ্রেণীর যে অংশটি সেদিন সমাজের আমলে পুনর্গঠনের দাবি তোলে, তারা সে সময় নিজেদের কমিউনিস্ট বলত। তখন পর্যন্ত এটা ছিল অমার্জিত, নিতান্ত সহজবোধের, প্রায়শই অনেকটা স্থূল কমিউনিজম মাত্র। তবুও ইউটোপীয় কমিউনিজমের দুটি ধারাকে জন্ম দেবার মতো শক্তি এর ছিল–ফ্রান্সে কাবে-র ‘আইকেরীয়’ (Icarian) কমিউনিজম এবং জার্মানিতে ভাইতলিং-এর কমিউনিজম। ১৮৪৭ সালে সমাজতন্ত্র বলতে বোঝাত একটা বুর্জোয়া আন্দোলন, কমিউনিজম বোঝাত শ্রমিক আন্দোলন। ইউরোপীয় ভূখন্ডে অন্তত তখন সমাজতন্ত্র ছিল বেশ ভদ্রস্থ, আর কমিউনিজম ছিল ঠিক তার বিপরীত। ততদিন আগেই যেহেতু আমাদের অতি দঢ় মত ছিল যে, ‘শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি হওয়া চাই শ্রমিক শ্রেণীরই নিজস্ব কাজ, তাই দুই নামের মধ্যে কোনটি বেছে নেব। সে সম্বন্ধে আমাদের কোনও দ্বিধা ছিল না। পরেও কখনো নাম বর্জন করার কথা আমাদের মনে আসেনি।
‘দুনিয়ার মজুর এক হও!’ বেয়াল্লিশ বছর আগে, প্রথম যে প্যারিস বিপ্লবে প্রলেতারিয়েত তার নিজস্ব দাবি নিয়ে হাজির হয় ঠিক তারই পূর্বক্ষণে আমরা যখন পথিবীর সামনে এই কথা ঘোষণা করেছিলাম, সেদিন অতি অল্প কণ্ঠেই তার প্রতিধ্বনি উঠেছিল। ১৮৬৪ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর কিন্তু পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ দেশের শ্রমিকেরা আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের সমিতিতে হাত মেলায়, এ সমিতির সমিতি অতি গৌরবর্জনক। সত্যকথা, আন্তর্জাতিক বেঁচে ছিল মাত্র নয় বছর। কিন্তু সকল দেশের শ্রমিকদের যে চিরন্তন ঐক্য এতে সৃষ্টি হয়েছিল, সে ঐক্য যে আজও জীবন্ত এবং আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী, বৰ্তমান কালটাই তার সর্বোত্তম সাক্ষ্য। কেননা ঠিক আজকের দিনে যখন আমি এই পংক্তিগুলি লিখছি তখন ইউরোপ ও আমেরিকার প্রলেতারিয়েত তাদের লড়বার শক্তি বিচার করে দেখছে, এই সর্বপ্রথম তারা সংঘবদ্ধ, সংঘবদ্ধ একক বাহিনী রূপে, এক পতাকার নিচে, একটি উপস্থিত লক্ষ্য নিয়ে: ১৮৬৬ সালে আন্তর্জাতিকের জেনেভা কংগ্রেসে ও আবার ১৮৮৯ সালে প্যারিস শ্রমিক কংগ্রেসে যা ঘোষিত হয়েছিল। সেইভাবে আইন পাশ করে সাধারণ আট ঘণ্টা শ্রমদিন চালু করতে হবে। আজকের দিনের দশ্য সকল দেশের পুঁজিপতি ও জমিদারদের চোখে আঙ্গল দিয়ে দেখিয়ে দেবে যে আজ সকল দেশের শ্রমিকেরা সত্যই এক হয়েছে।