যদিও ‘ইশতেহার’ আমাদের দুজনের রচনা, তবু আমার মনে হয় আমার বলা উচিত যে, এর মূলে রয়েছে যে-প্রধান বক্তব্য সেটা মার্কসেরই নিজস্ব। সে বক্তব্য হল এই : ইতিহাসের প্রতি যুগে অর্থনৈতিক উৎপাদন ও বিনিময়ের প্রধান পদ্ধতি এবং তার আবশ্যিক ফল যে সামাজিক সংগঠন তাই হল একটা ভিত্তি যার ওপর গড়ে ওঠে সে যুগের রাজনৈতিক ও মানসিক ইতিহাস এবং একমাত্র তা দিয়েই এ ইতিহাসের ব্যাখ্যা করা চলে; সুতরাং মানবজাতির সমগ্র ইতিহাস (জমির উপর যৌথ মালিকানা সম্পাবলিত আদিম উপজাতীয় সমাজের অবসানের পর থেকে) হল শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস, শোষক এবং শোষিত, শাসক এবং নিপীড়িত শ্রেণীর সংগ্রামের ইতিহাস; শ্রেণী-সংগ্রামের এই ইতিহাস হল বিবর্তনের এক ধারা যা আজকের দিনে এমন পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে যেখানে একই সঙ্গে গোটা সমাজকে সকল শোষণ, নিপীড়ন, শ্রেণী-পাৰ্থক্য ও শ্রেণী-সংগ্রাম থেকে চিরদিনের মতো মুক্তি না দিয়ে শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণীটি–অর্থাৎ প্রলেতারিয়েত–শোষক ও শাসকের, অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণীর কর্তৃত্বের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না।
ডারউইনের মতবাদ জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যা করেছে, আমার মতে এই সিদ্ধান্ত ইতিহাসের বেলায়। তাই করতে বাধ্য। ১৮৪৫ সালের আগেকার কয়েক বছর ধরে আমরা দরজনেই ধীরে ধীরে এই সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে চলেছিলাম। সর্বতন্ত্রভাবে আমি কতটা এদিকে অগ্রসর হয়েছিলাম তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন আমার ‘ইংলন্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা’ বইখানি।(3) কিন্তু যখন ১৮৪৫ সালের বসন্তকালে ব্রাসেলস শহরে মার্কসের সঙ্গে আমার আবার দেখা হল, তখন মার্কস ইতিমধ্যে সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছেন। এখানে আমি যে ভাষায় মূল কথাটা উপস্থিত করলাম প্রায় তেমন পরিষ্কারভাবেই তিনি তখনই তা আমার সামনে তুলে ধরেছিলেন।
১৮৭২ সালের জার্মান সংস্করণে আমাদের মিলিত ভূমিকা থেকে নিম্নলিখিত কথাগালি উদ্ধত করছি:
‘গত পাঁচিশ বছরে বাস্তব অবস্থা যতই বদলে যাক না কেন, এই ‘ইশতেহার’এ যে সব সাধারণ মূলনীতি নির্ধারিত হয়েছিল তা আজও মোটের ওপর ঠিক আগের মতোই সঠিক। এখানে ওখানে সামান্য দু’একটি কথা আরও ভাল করে লেখা যেত। সর্বত্র এবং সবসময় মূলনীতিগুলির ব্যবহারিক প্রয়োগ নির্ভর করবে তখনকার ঐতিহাসিক অবস্থার উপর, ‘ইশতেহার’এর ভিতরেই সে কথা রয়েছে। সেইজন্য দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষে যেসব বিপ্লবী ব্যবস্থার প্রস্তাব আছে তার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়নি। আজকের দিনে হলে এ অংশটা নানা দিক থেকে অন্যভাবে লিখতে হত। ১৮৪৮-এর পর থেকে আধুনিক যন্ত্রশিল্প যে বিপুল পদক্ষেপে এগিয়ে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি সংগঠন উন্নত ও প্রসারিত হয়েছে, প্রথমে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে, পরে আরও বেশী করে প্যারিস কমিউনে, যেখানে প্রলেতারিয়েত এই সব প্রথম পরো দুই মাস ধরে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেছিল, তাতে যে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে তার ফলে এই কর্মসূচি খুঁটিনাটি কিছু ব্যাপারে সেকেলে হয়ে পড়েছে। কমিউন বিশেষ করে একটা কথা প্রমাণ করেছে যে: “তৈরি রাষ্ট্রযন্ত্রটা শুধু দখলে পেয়েই শ্রমিক শ্রেণী তা নিজের কাজে লাগাতে পারে না।” (ফ্রান্সে গৃহযদ্ধ; আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের সমিতির সাধারণ পরিষদের বিবৃতি, লণ্ডন, ট্রুলাভ, ১৮৭১, ১৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য; সেখানে কথাটা আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।) তাছাড়া একথাও স্বতঃস্পষ্ট যে, সমাজতন্ত্রী সাহিত্যের সমালোচনাটি আজকের দিনের হিসাবে অসম্পূর্ণ, কারণ সে আলোচনার বিস্তার এখানে মাত্র ১৮৪৭ পর্যন্ত; তাছাড়া বিভিন্ন বিরোধী দলের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্পর্ক সম্বন্ধে বক্তব্যগলিও (চতুর্থ অধ্যায়ে), সাধারণ মূলনীতির দিক থেকে ঠিক হলেও, ব্যবহারিক দিক থেকে সেকেলে হয়ে গেছে, কেননা রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারে বদলে গেছে, এবং উল্লিখিত রাজনৈতিক দলগালির অধিকাংশকে ইতিহাসের অগ্রগতি এ জগৎ থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় দিয়েছে।
‘কিন্তু এই ‘ইশতেহার’ এখন ঐতিহাসিক দলিল হয়ে পড়েছে, একে বদলাবার কোনও অধিকার আমাদের আর নেই।‘
মার্কসের ‘পুঁজি’ বইটির বেশির ভাগটার অনুবাদক, মিঃ স্যামুয়েল মুর এই অনুবাদ করেছেন। আমরা দজনে মিলে এর সংশোধন করেছি; কয়েকটি ঐতিহাসিক উল্লেখের ব্যাখ্যা হিসাবে কিছু টীকা আমি সংযোজন করেছি।
ফ্রেডরিক এঙ্গেলস
লণ্ডন, ৩০শে জানুয়ারি, ১৮৮৮
—————
1) লাসাল আমাদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে সবাদাই কবীকার করতেন যে তিনি মাকাসের শিষ্য এবং সেই হিসাবে ইশতেহারের উপরেই তাঁর ভিত্তি। কিন্তু ১৮৬২-৬৪ সালের প্রকাশ্য আন্দোলনে তিনি রান্মের ক্রেডিটের সাহায্যে উৎপাদক সমবায়ের দাবির বেশি অগ্রসর হননি। (এঙ্গেলসের টীকা।)
2) অনুবাদ করেছিলেন গ, ভা, প্লেখানভ; স্বয়ং এঙ্গেলস পরে ‘রাশিয়ায় সামাজিক সম্পর্ক” প্রবন্ধের পানশাচ অংশে কথাটা লিখে গেছেন।–সম্পাঃ
3) ‘The Condition of the Working Class in England in 1844.’ By Frederick Engels. Translated by Florence K. Wishnewetzky, New York, Lovell–London.
W. Reeves, 1888. (এঙ্গেলসের টীকা)
১৮৯o সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকা থেকে
‘ইশতেহারের’ একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে। সংখ্যায় তখন পর্যন্ত বেশি নয়, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের এহেন অগ্ৰণীদের কাছ থেকে এর প্রকাশকালে জুটেছিল সোৎসাহ অভ্যর্থনা (প্রথম ভূমিকায় উল্লিখিত অনুবাদগুলিই তার প্রমাণ), কিন্তু ১৮৪৮ সালের জুনে প্যারিস শ্রমিকদের পরাজয়ের পর যে প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হয়, তার চাপে বাধ্য হয়ে একে পশ্চাদপসারণ করতে হল; এবং ১৮৫২ সালের নভেম্বরে কলোন কমিউনিস্টদের দন্ডাজ্ঞার পর শেষপর্যন্ত ‘আইন অনুসারে’ তাকে আইন বহির্ভূত করা হয়। ফেব্রুয়ারি বিপ্লব থেকে যে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল, লোকচক্ষু থেকে তার অপসারণের সঙ্গে সঙ্গে ‘ইশতেহার’ও অন্তরালে যায়।