১৮৪৮ সালের জন মাসে প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়ার প্রথম মহাসংগ্রাম, প্যারিস অভ্যুত্থানের পরাজয় ইউরোপীয় শ্রমিক শ্রেণীর সামাজিক ও রাজনৈতিক দাবিকে ফের কিছদিনের মতো পিছনে হটিয়ে দিল। তারপর থেকে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের আগেকার মতো ফের কেবল মালিক শ্রেণীর নানা অংশের মধ্যেই ক্ষমতা দখলের লড়াই চলতে থাকে; শ্রমিক শ্রেণীকে নেমে আসতে হয় রাজনৈতিক অস্তিত্বের লড়াইটুকুতে, মধ্য শ্রেণীর র্যাডিকাল দলের চরমপন্থী অংশ রূপে দাঁড়াতে হয় তাদের। যেখানেই স্বাধীন প্রলেতারীয় আন্দোলনে জীবনের লক্ষণ দেখা গেল, সেখানেই তাকে দমন করা হল নির্মমভাবে। এইভাবেই, সে সময়ে কলোন শহরে অবস্থিত কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্ৰীয় কমিটিতে হানা দেয় প্রাশিয়ার পুলিশ। তার সভ্যরা গ্রেপ্তার হল এবং আঠারো মাস কারাবাসের পর ১৮৫২ সালের অক্টোবরে তাদের বিচার হয়। এই প্ৰসিদ্ধ “কলোন কমিউনিসটদের বিচার” চলেছিল ৪ঠা অক্টোবর থেকে ১২ই নভেম্বর; বন্দীদের সাতজনকে তিন থেকে ছয় বছরের কারাদন্ড দেওয়া হল এক দুর্গের অভ্যন্তরে। দন্ড ঘোষণার অব্যবহিত পরে, বাকি সভ্যরা লীগ সংগঠনকে আনষ্ঠানিকভাবে তুলে দেয়। আর ‘ইশতেহার’ সম্বন্ধে মনে হল যে এরপর থেকে তার ভাগ্যে বিস্মৃতির নির্বন্ধ।
ইউরোপীয় শ্রমিক শ্রেণী যখন শাসক শ্রেণীর উপর আর একটা আক্রমণের মতো পৰ্যাপ্ত শক্তি ফিরে পায়, তখন আবির্ভূত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের সমিতি (International Working Men’s Association)। ইউরোপ ও আমেরিকার সমগ্ৰ জঙ্গী প্রলেতারিয়েতকে এক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংগঠিত করার বিশেষ উদ্দেশ্য থাকার দরুন এই সমিতি কিন্তু ইশতেহার এ লিপিবদ্ধ মলনীতিগুলি সরাসরি ঘোষণা করতে পারেনি। আন্তর্জাতিকের কর্মসূচি বাধ্য হয়েই এতটা উদার করতে হয় যাতে তা গ্রহণীয় হয় ইংরেজ ট্রেড ইউনিয়ন, ফ্রান্স-বেলজিয়ম-ইতালি ও স্পেনের প্রুধোঁবাদী, এবং জার্মান লাসালপন্থীদের(1) কাছে। এই কর্মসূচি মার্কস রচনা করেছিলেন এই সকল দলের সন্তোষ বিধান করে; মিলিত কাজ ও পারস্পরিক আলোচনার ফলে শ্রমিক শ্রেণীর বৃদ্ধিগত যে বিকাশ ছিল সুনিশ্চিত, তার উপরেই তিনি পূর্ণ আস্থা রেখেছিলেন। পুঁজির সঙ্গে সংগ্রামের ঘটনা ও দুর্বিপাকেই, জয়লাভের চাইতেও পরাজয়ে শ্রমিকদের এই জ্ঞানোদয় না হয়ে পারেনি যে তাদের সাধের নানা টোটকাগুলি (nostrums) অপৰ্যাপ্ত, শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির আসল শত সম্বন্ধে পূর্ণতর অন্তদৃষ্টির পথ না কেটে পারেনি। মার্কস ঠিকই বুঝেছিলেন। ১৮৬৪ সালে আন্তর্জাতিক সৃষ্টির সময় শ্রমিকরা যে অবস্থায় ছিল তা থেকে একেবারে ভিন্ন মানষ হয়ে তারা বেরিয়ে আসে। ১৮৭৪ সালে আন্তর্জাতিক ভেঙে যাবার সময়। ফ্রান্সে প্রুধোঁবাদ, জার্মানিতে লাসালপন্থা তখন মুহূর্ষু; এমনকি রক্ষণশীল ইংরেজ ট্রেড ইউনিয়নগলিও, তাদের অধিকাংশ বহুদিন যাবৎ আন্তর্জাতিকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে থাকলেও, ধীরে ধীরে এতদূর পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে যে গত বছর সোয়ানসি শহরে তাদের সভাপতি তাদের নামেই ঘোষণা করতে পারলেন: ‘ইউরোপীয় ভূখন্ডের সমাজতন্ত্র আমাদের কাছে আর বিভীষিকা নেই।‘ বস্তৃত, সকল দেশের মেহনতী মানুষের মধ্যে ইশতেহারের নীতিগুলি অনেক পরিমাণে ছড়িয়েছে।
তাই ‘ইশতেহার’ আবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৮৫o সালের পর তার মূল জার্মান পাঠ কয়েকবার পুনর্মুদ্রিত হয়েছে সুইজারল্যান্ড, ইংলণ্ড ও আমেরিকাতে। ১৮৭২ সালে নিউ ইয়র্কে ইংরেজী অনুবাদ হয়েছিল, অনুবাদটি সেখানকার Woodhull and Claflin’s Weekly-তে প্রকাশিত হয়। এই ইংরেজী পাঠ থেকে একটা ফরাসী অনুবাদ হয় নিউ ইয়র্কের Le Socialiste পত্রিকায়। এরপর কিছুটা বিকৃতি সহ অন্তত আরও দুটি ইংরেজী অনুবাদ আমেরিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে একটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে ইংলন্ডে। প্রথম রুশ অনুবাদ বাকুনিনের করা, সেটি জেনেভা শহরে গেৎসেনের ‘কলোকোল’ অফিসে প্রকাশিত হয়। ১৮৬৩ আন্দাজ; দ্বিতীয় অনুবাদ করেন বীরনারী ভেরা জাসুলিচ(2), তা বের হয় ১৮৮২ সালে জেনেভাতেই। এক নতুন ডেনিশ সংস্করণ পাওয়া যাবে কোপেনহাগেনে ১৮৮৫ সালের Social-demokratisk Bibliothek-এ; নতুন এক ফরাসী অনুবাদ আছে প্যারিসে ১৮৮৫ সালের Le Socialiste পত্রিকায়। শেষেরটি অনুসরণে একটা স্পেনীয় অনুবাদ মাদ্রিদে ১৮৮৬ সালে প্ৰস্তুত ও প্রকাশিত হয়। জার্মান পুনর্মুদ্রণের সংখ্যা অশেষ, খব কম করেও অন্তত বারো। কয়েক মাস আগে কনস্ট্যাণ্টিনোপল থেকে একটা আমেনিয়ান অনুবাদের কথা ছিল, কিন্তু তা প্রকাশিত হয়নি শুনেছি এই জন্য যে প্রকাশক মার্কসের নামাঙ্কিত বই বের করতে সাহস পাননি। আর অনুবাদক লেখাটা নিজের বলে প্রচার করতে গররাজী হন। অন্যান্য ভাষায় আরও অনুবাদের কথা আমি শুনেছি কিন্তু নিজের চোখে দেখিনি। সুতরাং ইশতেহারের ইতিহাস অনেকাংশে আধুনিক শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসই প্রতিফলিত করছে; আজকের দিনে সমগ্র সমাজতন্ত্রী সাহিত্যের সবচেয়ে প্রচারিত, সর্বাধিক আন্তর্জাতিক সাহিত্য-কীর্তি এইটেই; সাইবেরিয়া থেকে কালিফোর্নিয়া পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ মেহনতী মানুষে একে মেনে নিয়েছে নিজেদের সাধারণ কর্মসূচি হিসাবে।
কিন্তু লেখার সময়ে একে সমাজতন্ত্রী ইশতেহার বলা সম্ভব ছিল না। ১৮৪৭ সালে সমাজতন্ত্রী নামে বোঝাত একদিকে বিভিন্ন ইউটোপীয় মতবাদের অ্নুগামীদের : যেমন ইংলন্ডে ওয়েন-পন্থী, ফ্রান্সে ফুরিয়ে-পন্থীরা, উভয়েই তখন সংকীর্ণ গোষ্ঠীর পর্যায়ে নেমে গিয়ে ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছিল; অন্যদিকে বোঝাত অতি বিচিত্র সব সামাজিক হাতুড়েদের, এরা নানাবিধ তুকতাকে পুঁজি ও মনাফার কোনও ক্ষতি না করে সব প্রকার সামাজিক অভিযোগের প্রতীকার করার প্রতিশ্রুতি দিত। উভয় ক্ষেত্রের লোকেরাই ছিল শ্রমিক আন্দোলনের বাইরে, উভয়েরই চোখ ছিল ‘শিক্ষিত’ সম্প্রদায়ের সমর্থনের দিকেই। শ্রমিক শ্রেণীর যেটুকু অংশ নিতান্ত রাজনৈতিক বিপ্লবের অপব্যাপ্ততা বুঝেছিল, সমাজের সম্পৰ্ণে বদলের প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা করেছিল, সেই অংশ তখন নিজেদের কমিউনিস্ট নামে পরিচয় দিত। অবশ্য এ ছিল একটা কাঁচা, অমার্জিত, নিতান্তই সহজবোধের কমিউনিজম; তব এতে মূলকথাটা ধরা পড়েছিল এবং শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে এর এতটা প্রভাব ছিল যে এ থেকে জন্ম নেয়। ফ্রান্সে কাবে-র ও জার্মানিতে ভাইতলিং-এর ইউটোপীয় কমিউনিজম। তাই ১৮৪৭ সালে সমাজতন্ত্র ছিল বুর্জোয়া আন্দোলন আর কমিউনিজম শ্রমিক শ্রেণীর। অন্তত ইউরোপ মহাদেশে সমাজতন্ত্র ছিল ভদ্ৰস্থ; আর কমিউনিজম ছিল ঠিক তার বিপরীত। আর প্রথম থেকেই যেহেতু আমাদের ধারণা ছিল যে ‘শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি হওয়া চাই শ্রমিক শ্রেণীরই নিজস্ব কাজ, তাই দুই নামের মধ্যে কোনটা আমরা নেব সে সম্বন্ধে কোন সংশয় ছিল, না। তাছাড়া আজ পর্যন্ত আমরা এ নাম বর্জন করার দিকেও যাইনি।