শ্ৰেণী-সংগ্রামের অপরিণত অবস্থা এবং তাঁদের স্বকীয় পরিবেশের দরুন এই ধরনের সমাজতন্ত্রীরা মনে করতেন যে তাঁরা সকল শ্রেণীবিরোধের বহু ঊর্ধ্বে। তাঁরা চেয়েছিলেন সমাজের প্রত্যেক সদস্যের, এমন কি সবচেয়ে সুবিধাভোগীর অবস্থাও উন্নত করতে। সেইজন্য সাধারণত শ্রেণী:নির্বিশেষে গোটা সমাজের কাছে আবেদন জানানো; এমন কি তুলনায় শাসক শ্রেণীর কাছেই আবেদন-নিবেদন ছিল এঁদের পছন্দ। কেননা, এঁদের ব্যবস্থাটা একবার বুঝতে পারলে লোকে কেমন করে না দেখে পারবে যে এইটাই সমাজের সর্বোত্তম-সম্ভব ব্যবস্থার জন্য সর্বোত্তম-সম্ভব পরিকল্পনা?
সেইজন্য সকল রাজনৈতিক, বিশেষত সকল বিপ্লবী প্রচেস্টাকে এঁরা বর্জন করলেন; এদের অভিলাষ হল শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিজেদের উদ্দেশ্যসাধন; চেষ্টা হল দৃষ্টান্তের জোরে, এবং যার ভাগ্যে ব্যর্থতাই আনিবাৰ্য এমন ছোটখাট পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন সামাজিক বেদের (Gospel) পথ কাটতে।
ভবিষ্যৎ সমাজের এ ধরনের উদ্ভট ছবি আঁকা হয় এমন সময়ে যখন প্রলেতারিয়েত অতি অপরিণত অবস্থার মধ্যে ছিল, নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে তাদের ধারণাও ছিল উদ্ভট; সমাজের ব্যাপক পুনর্গঠন সম্বন্ধে এ শ্রেণীর প্রাথমিক স্বতঃস্ফীত আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এ ধরনের ছবির মিল দেখা যায়।
কিন্তু সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট এই সব লেখার মধ্যে সমালোচনামলেক একটা দিকও আছে। বর্তমান সমাজের প্রত্যেকটি নীতিকে এরা আক্রমণ করল। তাই শ্রমিক শ্রেণীর জ্ঞানলাভের পক্ষে অনেক অমল্য তথ্যে তা পরিপূর্ণ। শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে প্রভেদ, পরিবার প্রথা, ব্যক্তিবিশেষের লাভের জন্য শিল্প পরিচালনা ও মজুরিশ্রমের উচ্ছেদ, সামাজিক সৌষম্য ঘোষণা, রাষ্ট্রের কাজকে কেবলমাত্র উৎপাদনের তদারকে রূপান্তরিত করণ ইত্যাদি যেসব ব্যবহারিক প্রস্তাব এই লেখার মধ্যে আছে তাদের সবকটাই শ্রেণীবিরোধের অন্তৰ্ধানের দিকেই কেবল অঙ্গলি নির্দেশ করে, অথচ সে বিরোধ সেদিন সবেমাত্র মাথা তুলছিল, এই সব লেখার মধ্যে ধরা পড়েছিল তাদের, আদি অস্পষ্ট আনিদিলন্ট রপটুকু। প্রস্তাবগলির প্রকৃতি তাই নিতান্তই ইউটোপীয়।
সমালোচনামূলক-ইউটোপীয় সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের যা তাৎপৰ্য তার সঙ্গে ঐতিহাসিক বিকাশের সম্বন্ধটা বিপরীতমখী। আধুনিক শ্রেণী-সংগ্রাম যতই বিকশিত হয়ে সুনিদিষ্ট রূপে নিতে থাকে, ঠিক ততই এই উদ্ভট সংগ্রাম-পরিহারের, শ্রেণীসংগ্রামের বিরদ্ধে এইসব উদ্ভট আক্রমণের সকল ব্যবহারিক মাল্য ও তাত্ত্বিক ব্যক্তি হারায়। সেইজন্যই, এই সমস্ত মতবাদের প্রবর্তকেরা অনেক দিক দিয়ে বিপ্লবী হলেও তাঁদের শিষ্যরা প্রতিক্ষেত্রে কেবল প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীতেই পরিণত হয়েছে। প্রলেতারিয়েতের প্রগতিশীল ঐতিহাসিক বিকাশের বিপরীতে তারা নিজ নিজ গুরুর আদি মতগুলিকেই আঁকড়ে ধরে আছে। তাই তাদের অবিচল চেষ্টা যেন শ্রেণী-সংগ্রাম নিস্তেজ হয়ে পড়ে, যেন শ্রেণীবিরোধ আপসে মিটে যায়। তারা এখনও তাদের সামাজিক ইউটোপিয়ার পরীক্ষামলক রূপায়ণের স্বপ্ন দেখে; বিচ্ছিন্ন ‘ফালানস্টের’ প্রতিষ্ঠা, ‘হোম কলোনি’ স্থাপন, ‘ছোট আইকেরিয়া’(5) প্রবর্তনের স্বপ্ন দেখে, নব জেরুজালেমের ক্ষুদ্ৰাদপি ক্ষদ্র সংস্করণ হিসাবে; — আর এই আকাশকুসম বাস্তব করার জন্য আবেদন জানায় বুর্জোয়া শ্রেণীর সহানভূতি ও টাকার থলির কাছে। আগে যে প্রতিক্রিয়াপন্থী বা রক্ষণশীল সমাজতন্ত্রীদের বর্ণনা করা হয়েছে এরা ধীরে ধীরে নেমে যায়। সেই স্তরে; তফাৎ শুধু তাদের আরও প্রণালীবদ্ধ পাণ্ডিত্যে, এবং সমাজবিদ্যার অলৌকিক মাহাত্ম্যে অন্ধ ও সংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসে।
শ্রমিক শ্রেণীর সমস্ত রাজনৈতিক প্রচেস্টার এরা তাই তীব্র বিরোধী; এদের মতে সে প্রচেষ্টা কেবলমাত্র নব বেদে অন্ধ অবিশ্বাসের ফল।
ইংলন্ডে ওয়েনপন্থীরা এবং ফ্রান্সে ফুরিয়েভক্তরা যথাক্রমে চার্টিস্ট ও সংস্কারবাদীদের বিরোধী। (6)
৪। বর্তমান নানা সরকার-বিরোধী পার্টির সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্বন্ধ
শ্রমিক শ্রেণীর যে সব পার্টি এখন বিদ্যমান, যেমন ইংলন্ডে চার্টিস্টগণ ও আমেরিকায় কৃষি সংস্কারবাদীরা, তাদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্বন্ধ দ্বিতীয় অধ্যায়ে পরিষ্কার করা হয়েছে।
উপস্থিত লক্ষ্যসিদ্ধির জন্য, শ্রমিক শ্রেণীর সাময়িক স্বার্থ রক্ষার জন্য কমিউনিস্টরা লড়াই করে থাকে, কিন্তু আন্দোলনের বর্তমানের মধ্যেও তারা আন্দোলনের ভবিষ্যতের প্রতিনিধি, তার রক্ষক। ফ্রান্সে রক্ষণশীল এবং র্যাডিকাল বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে তারা সোশ্যাল-ডেমোক্রাটদের(7) সঙ্গে হাত মেলায়, কিন্তু মহান ফরাসী বিপ্লব থেকে ঐতিহ্য হিসাবে যে সব বাঁধা বুলি ও ভ্রান্তি চলে আসছে তার সমালোচনার অধিকারটুকু বর্জন না করে।
সুইজারল্যান্ডে সমর্থন করা হয় র্যাডিকালদের, কিন্তু এ সত্য ভোলা হয় না যে এ দলটি পরস্পরবিরোধী উপাদানে গঠিত, এদের খানিকটা ফরাসী অর্থে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী আবার খানিকটা হল র্যাডিকাল বুর্জোয়া।
পোল্যান্ডে তারা সেই দলটিকে সমর্থন করে যারা জাতীয় মুক্তির প্রাথমিক শর্ত হিসাবে কৃষি বিপ্লবের ওপর জোর দেয়, সেই দল যারা ১৮৪৬ সালের ক্রোকোভ বিদ্রোহে ইন্ধন জুগিয়েছিল।
জার্মানিতে বুর্জোয়ারা যখন বিপ্লবী অভিযান করে তখনই কমিউনিস্টরা তাদের সঙ্গে একত্রে লড়ে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র, সামন্ত জমিদারতন্ত্র এবং পেটি বুর্জোয়ার(8) বিরুদ্ধে।