আজ অবস্থা কত বদলে গেছে! ইউরোপ থেকে নবাগত লোকের বসতির দরুনই উত্তর আমেরিকা বহৎ কৃষি-উৎপাদনের যোগ্য ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে, তার প্রতিযোগিতা ইউরোপের ছোট বড় সমস্ত ভূসম্পত্তির ভিত পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলেছে। তাছাড়া এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র তার বিপুল শিল্পসম্পদকে এমন উৎসাহভরে ও এমন আয়তনে কাজে লাগাতে সমর্থ হয়েছে যে শল্পক্ষেত্রে পশ্চিম ইউরোপের, বিশেষ করে ইংলন্ডের যে একচেটিয়া অধিকার আজো রয়েছে, তা অচিরে ভেঙে পড়ুতে বাধ্য। এ দটি ব্যাপার আবার আমেরিকার উপরেই বিপ্লবী প্রতিক্রিয়া ঘটাচ্ছে। গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তিতে যে কৃষকের ছোট ও মাঝারি ভূসম্পত্তি ছিল, তা ক্ৰমে ক্ৰমে বৃহদায়তন খামারের প্রতিযোগিতায় অভিভূত হয়ে পড়ুছে; সেইসঙ্গে শিল্পাঞ্চলে এই প্রথম ঘটছে গণ প্রলেতারিয়েত ও অবিশ্বাস্য পুঁজি কেন্দ্রীভবনের বিকাশ।
তারপর রুশদেশা! ১৮৪৮-৪৯ সালের বিপ্লবের সময় শুধু ইউরোপীয় রাজন্যবাগ নয়, ইউরোপের বুর্জোয়া শ্রেণী পর্যন্ত সদ্যজাগরণোন্মুখ প্রলেতারিয়েতের হাত থেকে উদ্ধার পাবার একমাত্র উপায় দেখেছিল রাশিয়ার হস্তক্ষেপে। জার-কে তখন ঘোষণা করা হয়ে ছিল ইউরোপে প্রতিক্রিয়ার প্রধান নেতা হিসাবে। সেই জার। আজ বিপ্লবের কাছে গাৎচিনায় যাদ্ধবন্দীর মতন, আর ইউরোপে বিপ্লবী আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া।
আধুনিক বুর্জোয়া সম্পত্তির অনিবার্য আগতপ্ৰায় অবসান ঘোষণা করাই ছিল ‘কমিউনিস্ট ‘ইশতেহার’এর লক্ষ্য। কিন্তু রাশিয়াতে দেখি দ্রুত বর্ধিষ্ণু পুঁজিবাদী জয়াচুরি ও বিকাশোন্মুখ বুর্জোয়া ভূসম্পত্তির মাখামাখি রয়েছে দেশের অর্ধেকের বেশি জমি জড়ে চাষীদের যৌথ মালিকানা। সুতরাং প্রশান ওঠে যে অত্যন্ত দাবলি হয়ে এলেও জমির উপর মিলিত মালিকানার আদি রূপে এই রুশ অবশ্চিনা (obshchino)** কি কমিউনিসট সাধারণ মালিকানার উচ্চতর পর্যায়ে সরাসরি রূপান্তরিত হতে পারে? না কি পক্ষান্তরে তাকেও যেতে হবে। ভাঙনের সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যা পশ্চিমে ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারা হিসাবে প্রকাশ পেয়েছে?
এর একমাত্র যে উত্তর দেওয়া আজ সম্ভব তা হল এই: রাশিয়ায় বিপ্লব যদি পশ্চিমে প্রলেতারীয় বিপ্লবের সংকেত হয়ে ওঠে যাতে দুই বিপ্লব পরস্পরের পরিপারক হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে রুশদেশে ভূমির বর্তমান যৌথ মালিকানা কাজে লাগতে পারে কমিউনিস্ট বিকাশের সূত্রপাত হিসাবে।
কার্ল মার্কস–ফ্রেডারিক এঙ্গেলস
লণ্ডন, ২১শে জানুয়ারি, ১৮৮২
——————
* উল্লিখিত সংস্করণটি প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালে। তারিখটা এঙ্গেলস ভুলভাবে দিয়েছেন।–সম্পাদক
**অবশ্চিনা–গ্রামীণ সমাজ।–সম্পাদক
১৮৮৩ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকা
বৰ্তমান সংস্করণের ভূমিকা হায় আমাকে একলাই সই করতে হবে। ইউরোপ ও আমেরিকার সমগ্র শ্রমিক শ্রেণী যাঁর কাছে সবচাইতে বেশি ঋণী সেই মার্কস হাইগেট সমাধি-ভূমিতে শান্তিলাভ করেছেন। তাঁর সমাধির উপর ইতিমধ্যেই প্রথম তৃণরাজি মাথা তুলেছে। তাঁর মৃত্যুর পর ‘ইশতেহার’এ সংশোধন বা সংযোজন আরো অভাবনীয়। তাই এখানে স্পষ্টভাবে নিম্নলিখিত কথাগালি আবার বলা আমি প্রয়োজন মনে করি :
‘ইশতেহার’এর ভিতরে যে মলচিন্তা প্রবাহমান তা হল এই : ইতিহাসের প্রতি যুগে অর্থনৈতিক উৎপাদন এবং যে সমাজ-সংগঠন তা থেকে আবশ্যিকভাবে গড়ে ওঠে তা-ই থাকে সে যুগের রাজনৈতিক ও মানসিক ইতিহাসের মলে, সুতরাং (জমির আদিম যৌথ মালিকানার অবসানের পর থেকে) সমগ্র ইতিহাস হয়ে এসেছে শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস, সামাজিক বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ের শোষিত ও শোষক, অধীনস্থ ও অধিপতি শ্রেণীর সংগ্রামের ইতিহাস; কিন্তু এই লড়াই আজ এমন পৰ্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণী (প্রলেতারিয়েত) নিজেকে শোষক ও নিপীড়ক শ্রেণীর (বুর্জোয়া) কবল থেকে উদ্ধার করতে গেলে সেইসঙ্গে গোটা সমাজকে শোষণ, নিপীড়ন ও শ্রেণী-সংগ্রাম থেকে চিরদিনের মতো মুক্তি না দিয়ে পারে না। — এই মূল চিন্তাটি পুরোপুরি ও একমাত্র মার্কসেরই চিন্তা*।
একথা আমি বহবার বলেছি। কিন্তু ঠিক আজকেই এ বক্তব্য ‘ইশতেহার’এর পুরোভাগেও রাখা প্রয়োজন।
ফ্রেডারিক এঙ্গেলস
লণ্ডন, ২৮শে জুন, ১৮৮৩
—————
* ইংরেজী অনুবাদের মুখবন্ধে আমি লিখেছিলাম : ‘ডারউইনের মতবাদ জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যা করেছে, আমার মতে এই সিদ্ধান্ত ইতিহাসের বেলায় তাই করতে বাধ্য। ১৮৪৫ সালের আগেকার কয়েক বছর ধরে আমরা দুজনেই ধীরে ধীরে এই সিন্ধান্তের দিকে এগিয়ে চলেছিলাম। স্বতন্ত্রভাবে আমি কতটা এদিকে অগ্রসর হয়েছিলাম তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন আমার “ইংলন্ডে শ্ৰমিক শ্রেণীর অবস্থা” বইখানি। কিন্তু যখন ১৮৪৫ সালের বসন্তকালে ব্রাসেল্স্ শহরে মার্কসের সঙ্গে আমার আবার দেখা হল, তখন মার্কস ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছেন। এখানে আমি যে ভাষায় মূলকথাটা উপস্থিত করলাম প্রায় তেমন পরিষ্কারভাবেই তিনি তখনই তা আমার সামনে তুলে ধরেছিলেন।’ (১৮৯০ সালের জার্মান সংস্করণে এঙ্গেলসের টীকা।)
১৮৮৮ সালের ইংরেজী সংস্করণের ভূমিকা
মেহনতী মানুষের সংগঠন ‘কমিউনিস্ট লীগ’ প্রথমটা ছিল পুরোপুরি জার্মান ও পরে আন্তর্জাতিক, এবং ১৮৪৮ সালের আগেকার ইউরোপ মহাদেশের রাজনৈতিক অবস্থাতে তাকে অনিবার্যভাবে হতে হয় গুপ্ত সমিতি। এই ‘ইশতেহার’ প্রকাশিত হয়েছিল তারই কর্মসূচি হিসাবে। ১৮৪৭ সালের নভেম্বরে লীগের লণ্ডন কংগ্রেসে মার্কস ও এঙ্গেলসের উপর ভার দেওয়া হয়েছিল একটা বিশদ তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক পার্টি কর্মসূচি প্রকাশের জন্য প্রস্তুত করতে। ১৮৪৮-এর জানায়ারিতে জার্মানে লেখা পান্ডুলিপিটি ২৪শে ফেব্রুয়ারির ফরাসী বিপ্লবের কয়েক সপ্তাহ আগে লণ্ডনে মাদ্রাকরের কাছে পাঠানো হয়। ১৮৪৮ সালের জন অভ্যুত্থানের সামান্য আগে এর ফরাসী অনুবাদ প্যারিসে প্রকাশ হয়। শ্ৰীমতী হেলেন ম্যাকফারলেন কৃত প্রথম ইংরেজী অনুবাদ বের হয়। ১৮৫০ সালে লণ্ডনে জজ জলিয়ান হানির Red Republican পত্রিকায়। ডেনিশ ও পোলীয় সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছিল।