যেভাবে বিদেশী ভাষাকে আয়ত্ত করা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ অনুবাদের মাধ্যমে এই আত্মসাতের কাজ চলেছিল।
প্রাচীন পেগান জগতের চিরায়ত সাহিত্যের পুঁথিগুলির উপরেই সন্ন্যাসীরা কী ভাবে ক্যাথলিক সাধুদের নির্বোধ জীবনী লিখে রাখত সে কথা সুবিদিত। অপবিত্র ফরাসী সাহিত্যের ব্যাপারে জার্মান লেখকেরা এ পদ্ধতিটিকে উলেট দেয়। মূল ফরাসীর তলে তারা লিখল তাদের দার্শনিক ছাইপাঁশ। উদাহরণস্বরপ, মুদ্রার অর্থনৈতিক ক্রিয়ার ফরাসী সমালোচনার তলে তারা লিখল ‘মানবতার বিচ্ছেদ’; বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ফরাসী সমালোচনার নিচে লিখে রাখল ‘নির্বিশেষ এই প্রত্যয়ের সিংহাসনচ্যুতি’ ইত্যাদি।
ফরাসী ঐতিহাসিক সমালোচনার পিছনে এই সব দার্শনিক বুলি জুড়ে দিয়ে তার নাম তারা দেয় ‘কর্মযোগের দর্শন’, ‘খাঁটি সমাজতন্ত্র’, ‘সমাজতন্ত্রের জার্মান বিজ্ঞান’, ‘সমাজতন্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি’ ইত্যাদি।
ফরাসী সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট রচনাগুলিকে এইভাবে পুরোপুরি নির্বীর্য করে তোলা হয়। জার্মানদের হাতে যখন এ সাহিত্য এক শ্রেণীর সঙ্গে অপর শ্রেণীর সংগ্রামের অভিব্যক্তি হয়ে আর রইল না, তখন তাদের ধারণা হল যে ‘ফরাসী একদেশদর্শিতা’ অতিক্রম করা গেছে, সত্যকার প্রয়োজন নয় প্রকাশ করা গেছে সত্যের প্রয়োজনকে, প্রতিনিধিত্ব করা গেছে প্রলেতারিয়েতের স্বার্থের নয় মানব প্রকৃতির, নির্বিশেষ যে মানুষের শ্রেণী নেই, বাস্তবতা নেই, যার অস্তিত্ব কেবল দার্শনিক জলপনার কুয়াশাবত রাজ্যে তার স্বার্থের।
জার্মান এই যে সমাজতন্ত্র তার স্কুলছাত্রের কর্তব্যটাকেই অমন গুরুগম্ভীর ভারিক্কী চালে গ্রহণ করে সামান্য পশরাটা নিয়েই ক্যানভাসারের মতো গলাবাজি শুরু করেছিল তার পণ্ডিতি সারল্যাটাও কিন্তু ইতিমধ্যে ক্রমে ক্রমে ঘুচে গেছে।
সামন্ত আভিজাত্য ও নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের বিপক্ষে জার্মান, বিশেষ করে প্রাশিয়ার বুর্জোয়া শ্রেণীর লড়াইটা, অর্থাৎ উদারনৈতিক আন্দোলন তখন গুরুতর হয়ে ওঠে।
তাতে করে রাজনৈতিক আন্দোলনের সামনে সমাজতন্ত্রের দাবিগুলি তুলে ধরবার বহুবঞ্ছিত সংযোগ ‘খাঁটি’ সমাজতন্ত্রের কাছে এসে হাজির হয়, হাজির হয় উদারনীতি, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, বুর্জোয়া প্রতিযোগিতা, সংবাদপত্রের বুর্জোয়া স্বাধীনতা, বুর্জোয়া বিধান, বুর্জোয়া মুক্তি ও সাম্যের বিরদ্ধে চিরাচরিত অভিশাপ হানবার সুযোগ; জনগণের কাছে এই কথা প্রচারের সংযোগ যে এই বুর্জোয়া আন্দোলন থেকে তাদের লাভের কিছু নেই, সবকিছু হারাবারই সম্ভাবনা। ঠিক সময়টিতেই জার্মান সমাজতন্ত্র ভুলে গেল, যে-ফরাসী সমালোচনার সে মূঢ় প্রতিধ্বনি মাত্র সেখানে আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের অস্তিত্ব আগেই প্রতিষ্ঠিত, আর তার সঙ্গে ছিল অস্তিত্বের আনুষঙ্গিক অর্থনৈতিক অবস্থা ও তদুপযোগী রাজনৈতিক সংবিধান, অথচ জার্মানিতে আসন্ন সংগ্রামের লক্ষ্যই ছিল ঠিক এইগুলিই।
পুরোহিত, পন্ডিত, গ্রাম্য জমিদার, আমলা ইত্যাদি অনাচর সহ জার্মান স্বৈর সরকারগুলির কাছে আক্রমণোদ্যত বুর্জোয়া শ্রেণীকে ভয় দেখাবার চমৎকার জুজু হিসাবে তা কাজে লাগল।
ঠিক একই সময়ে এই সরকারিগুলি জার্মান শ্রমিক শ্রেণীর বিদ্ৰোহসমূহকে চাবুক ও গুলির যে তিক্ত ওষুধ গেলাচ্ছিল তার মধুরেণ সমাপয়েৎ হল এতে।
এই ‘খাঁটি’ সমাজতন্ত্র এদিকে এইভাবে সরকারগুলির কাজে লাগছিল জার্মান বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়ার হাতিয়ার হিসাবে, আর সেই সঙ্গেই তা ছিল প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থ, জার্মানির কূপমণ্ডূকদের স্বার্থের প্রতিনিধি। জার্মানিতে প্রচলিত অবস্থার প্রকৃত সামাজিক ভিত্তি ছিল পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী, ষোলো শতকের এই ভগ্নশেষটি তখন থেকে নানা মূর্তিতে বারবার আবির্ভূত হয়েছে।
এ শ্রেণীকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থ হল জার্মানির বর্তমান অবস্থাটাকেই জিইয়ে রাখা। বুর্জোয়া শ্রেণীর শিল্পগত ও রাজনৈতিক আধিপত্যে এ শ্রেণীর নির্ঘাত ধ্বংসের আশঙ্কা–একদিকে পুঁজি কেন্দ্ৰীভূত হওয়ার ফলে, অপরদিকে বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের অভ্যুদয়ে। মনে হল যেন এই দুই পাখিকে এক ঢিলেই মারতে পারবে ‘খাঁটি’ সমাজতন্ত্র। মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ুল তা।
জল্পনাকল্পনার মাকড়সার জালের পোশাক, তার উপর বাক্যালঙ্কারের নক্সী ফুল, অসুস্থ ভাবালুতার রসে সিক্ত এই যে স্বর্গীয় আচ্ছাদনে জার্মান সমাজতন্ত্রীরা তাদের অস্থিচর্মসার শোচনীয় ‘চিরন্তন সত্য’ দুটোকে সাজিয়ে দিল, তাতে এই ধরনের লোকসমাজে তাদের মালের অসম্ভব কাটতি বাড়ে।
কূপমণ্ডূক পেটি বুর্জোয়ার বাগাড়ম্বরী প্রতিনিধিত্বটাই তার কাজ, জার্মান সমাজতন্ত্র নিজের দিক থেকে তা হ্রমেই বেশি করে উপলব্ধি করতে থাকে।
তারা ঘোষণা করল যে জার্মান জাতি হল আদর্শ জাতি, কূপমণ্ডূক জার্মান মধ্যবিত্তই হল আদর্শ মানুষ। এই আদর্শ মানুষের প্রতিটি শয়তানী নীচতার এরা এক একটা গূঢ় মহত্তর সমাজতান্ত্রিক ব্যাখ্যা দিল, যা তার আসল প্রকৃতির ঠিক বিপরীত। এমন কি কমিউনিজমের ‘পাশবিক ধ্বংসাত্মক’ ঝোঁকের প্রত্যক্ষ বিরুদ্ধতা ও সব ধরনের শ্রেণী-সংগ্রাম সম্বন্ধে পরম ও নিরপেক্ষ অবজ্ঞা ঘোষণায় তার দ্বিধা হল না। আজকের দিনে (১৮৪৭) যত তথাকথিত সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট রচনা জার্মানিতে প্রচলিত, যৎসামান্য কয়েকটিকে বাদ দিলে তার সমস্তটাই এই কলুষিত ক্লান্তিকর সাহিত্যের পৰ্যায়ে পড়ে।(4)