ভিন্ন ভিন্ন দেশে অবশ্যই এই ব্যবস্থাগালি হবে বিভিন্ন।
তাসত্ত্বেও সবচেয়ে অগ্রসর দেশগুলিতে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগালি মোটের ওপর সাধারণভাবে প্রযোজ্য।
১। জমি মালিকানার অবসান; জমির সমস্ত খাজনা জনসাধারণের হিতার্থে ব্যয়।
২। উচ্চমাত্রার ক্রমবর্ধমান হারে আয়কর।
৩। সবরকমের উত্তরাধিকার বিলোপ।
৪। সমস্ত দেশত্যাগী ও বিদ্রোহীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তি।
৫। রাষ্ট্ৰীয় পুঁজি ও নিরঙ্কুশ একচেটিয়া সহ একটি জাতীয় ব্যাঙ্ক মারফত সমস্ত ক্রেডিট রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্ৰীকরণ।
৬। যোগাযোগ ও পরিবহনের সমস্ত উপায় রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীকরণ।
৭। রাষ্ট্ৰীয় মালিকানাধীন কলকারখানা ও উৎপাদন-উপকরণের প্রসার; পতিত জমির আবাদ এবং এক সাধারণ পরিকল্পনা অনুযায়ী সমগ্র জমির উন্নতিসাধন।
৮। সকলের পক্ষে সমান শ্রমবাধ্যতা। শিল্পবাহিনী গঠন, বিশেষত কৃষিকার্যের জন্য।
৯। কৃষিকার্যের সঙ্গে যন্ত্রশিল্পের সংযক্তি; সারা দেশের জনসংখ্যার আরো বেশি সমভাবে বণ্টন মারফত ক্ৰমে ক্ৰমে শহর ও গ্রামের প্রভেদ লোপ।
১০। সরকারী বিদ্যালয়ে সকল শিশুর বিনা খরচে শিক্ষা। ফ্যাক্টরিতে বৰ্তমান ধরনের শিশু শ্রমের অবসান। শিল্পোপাৎপাদনের সঙ্গে শিক্ষার সংযক্তি ইত্যাদি।
বিকাশের গতিপথে যখন শ্রেণী-পার্থক্য অদশ্য হয়ে যাবে, সমস্ত উৎপাদন যখন গোটা জাতির এক বিপুল সমিতির হাতে কেন্দ্রীভূত হবে, তখন সরকারী (পাবলিক) শক্তির রাজনৈতিক চরিত্র আর থাকবে না। সঠিক অর্থে রাজনৈতিক ক্ষমতা হল এক শ্রেণীর উপর অত্যাচার চালাবার জন্য অপর শ্রেণীর সংগঠিত শক্তি মাত্র। বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে লড়াই-এর ভিতর অবস্থার চাপে যদি প্রলেতারিয়েত নিজেকে শ্রেণী হিসাবে সংগঠিত করতে বাধ্য হয়, বিপ্লবের মাধ্যমে তারা যদি নিজেদের শাসক শ্রেণীতে পরিণত করে ও শাসক শ্রেণী হিসাবে উৎপাদনের পরাতন ব্যবস্থাকে তারা যদি ঝেঁটিয়ে বিদায় করে, তাহলে সেই পুরানো অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণীবিরোধ তথা সবরকম শ্রেণীর অস্তিত্বটাই দূর করে বসবে এবং তাতে করে শ্রেণী হিসাবে তাদের স্বীয় আধিপত্যেরও অবসান ঘটবে।
শ্রেণী ও শ্রেণীবিরোধ সংবলিত পুরানো বুর্জোয়া সমাজের স্থান নেবে এক সমিতি যার মধ্যে প্রত্যেকটি লোকেরই সর্বাধীন বিকাশ হবে সকলের স্বাধীন বিকাশের শর্ত।
৩. সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট সাহিত্য
সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট সাহিত্য
১। প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্র
ক। সামন্ত সমাজতন্ত্র
স্বীয় ঐতিহাসিক পরিস্থিতির কারণে ফ্রান্স ও ইংলন্ডের অভিজাতদের কাছে আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের বিরুদ্ধে পুস্তিকা লেখা একটা কাজ হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৩০ সালের জুলাই মাসের ফরাসী বিপ্লবে এবং ইংলন্ডে সংস্কার আন্দোলনে ঘৃণ্য ভুঁইফোড়দের হাতে এদের আবার পরাভব হল। এরপর এদের পক্ষে একটা গুরুতর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা চালানোর কথাই ওঠে না। সম্ভব রইল একমাত্র মসীযুদ্ধ।
কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রেও রেস্টোরেশন (restoration)(1) যুগের পুরানো ধ্বনিগুলি তখন অচল হয়ে পড়েছে।
লোকের সহানভূতি উদ্রেকের জন্য অভিজাতেরা বাধ্য হল বাহ্যত নিজেদের স্বার্থ ভুলে কেবল শোষিত শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থেই বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ খাড়া করতে। এইভাবেই অভিজাতেরা প্রতিশোধ নিতে লাগল তাদের নতুন প্ৰভুদের নামে টিটকারি দিয়ে, তাদের কানে কানে আসন্ন প্রলয়ের ভয়াবহ ভবিষ্যদ্বাণী শুনিয়ে।
এইভাবে উদয় হয় সামন্ত সমাজতন্ত্রের : তার অর্ধেক বিলাপ আর অর্ধেক টিটকারি; অর্ধেক অতীতের প্রতিধ্বনি এবং অর্ধেক ভবিষ্যতের হমকি; মাঝে মাঝে এদের তিক্ত, সব্যঙ্গ ও সুতীক্ষ্ণ সমালোচনা বুর্জোয়াদের মর্মে গিয়ে বিঁধত; অথচ আধুনিক ইতিহাসের অগ্রগমন বোধের একান্ত অক্ষমতায় মোট ফলটা হত হাস্যকর।
জনগণকে দলে টানার জন্য অভিজাতবর্গ নিশান হিসাবে তুলে ধরত মজুরের ভিক্ষার থলিটাকে। লোকরা কিন্তু যতবারই দলে ভিড়েছে ততবারই এদের পিছনদিকটায় সামন্ত দরবারী চাপরাশ দেখে হো হো করে অশ্রদ্ধার হাসি হেসে ভোগে গেছে।
এ প্রহসনটা দেখায় ফরাসী লেজিটিমিস্টদের একাংশ এবং ‘নবীন ইংলন্ড’ গোষ্ঠী।(2)
বুর্জোয়া শোষণ থেকে তাদের শোষণ পদ্ধতি অন্য ধরনের ছিল এটা দেখাতে গিয়ে সামন্তপন্থীরা মনে রাখে না যে সম্পৰ্ণে পৃথক পরিস্থিতি ও অবস্থায় তাদের শোষণ চলত, যা আজকের দিনে অচল হয়ে পড়েছে। তাদের আমলে আজকালকার প্রলেতারিয়েতের অস্তিত্বই ছিল না দেখাতে গিয়ে তারা ভুলে যায় যে তাদের নিজস্ব সমাজেরই অনিবাৰ্য সন্তান হল আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণী।
তাছাড়া অন্য সব ব্যাপারে নিজেদের সমালোচনার প্রতিক্রিয়াশীল রূপটা এরা এত কম ঢাকে যে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে এদের প্রধান অভিযোগ দাঁড়ায় এই যে, বুর্জোয়া রাজত্বে এমন এক শ্রেণী গড়ে উঠছে, সমাজের পুরানো ব্যবস্থাকে আগাগোড়া নির্মূল করাই যার নির্বন্ধ।
বুর্জোয়া শ্রেণী প্রলেয়তারিয়েত সৃষ্টি করছে তার জন্য তত নয়, বিপ্লবী প্রলেতারিয়েত সৃষ্টি করছে এটাই হল এদের অভিযোগ।
সুতরাং রাজনীতির কার্যক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে দমনের সকল ব্যবস্থায় এরা যোগ দেয়; আর সাধারণ জীবনযাত্রায় বড় বড় বুলি সত্ত্বেও যন্ত্রশিল্পরূপ গাছের সোনার ফল কুড়িয়ে নিতে এদের আপত্তি নেই; পশম, বীটচিনি, অথবা আলর মদের(3) ব্যবসার জন্য সত্য, প্ৰেম, মর্যাদা বেচতে এদের দ্বিধা হয় না।