বুর্জোয়া বিবাহ হল আসলে অনেকে মিলে সাধারণ স্ত্রী রাখার ব্যবস্থা। সুতরাং কমিউনিস্টদের বিরদ্ধে বড় জোর এই বলে অভিযোগ আনা সম্ভব যে ভন্ডামির আড়ালে মেয়েদের উপর সাধারণ যে অধিকার লুকানো রয়েছে সেটাকে এরা প্রকাশ্য আইনসম্মত রূপে দিতে চায়। এটুকু ছাড়া একথা স্বতঃসিদ্ধ যে আধুনিক উৎপাদন-পদ্ধতি লোপের সঙ্গে সঙ্গে সেই পদ্ধতি থেকে উদ্ভূত মেয়েদের উপর সাধারণ অধিকারেরও অবসান আসবে, অর্থাৎ প্রকাশ্য ও গোপন দুই ধরনের বেশ্যাবৃত্তিই শেষ হয়ে যাবে।
কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ যে তারা চায় সর্বদেশ ও জাতিসত্তার বিলোপ।
মেহনতীদের দেশ নেই। তাদের যা নেই তা আমরা কেড়ে নিতে পারি না। প্রলেতারিয়েতকে যেহেতু সর্বাগ্রে রাজনৈতিক আধিপত্য অর্জন করতে হবে, দেশের পরিচালক শ্রেণীর পদে উঠতে হবে, নিজেকেই জাতি হয়ে উঠতে হবে, তাই সেদিক থেকে প্রলেতারিয়েত নিজেই জাতি, যদিও কথাটার বুর্জোয়া অর্থে নয়।
বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশ, বাণিজ্যের স্বাধীনতা, জগৎজোড়া বাজার, উৎপাদন-পদ্ধতি এবং তার অনুগামী জীবনযাত্রায় ধরনে একটা সার্বজনীন ভাব–এই সবের জন্যই জাতিগত পার্থক্য ও জাতিবিরোধ দিনের পর দিন ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে।
প্রলেতারিয়েতের আধিপত্য তাদের আরও দ্রুত অবসানের কারণ হবে।
প্রলেতারিয়েতের মুক্তির অন্যতম প্রধান শর্তই হল মিলিত প্রচেষ্টা, অন্তত অগ্রণী সভ্য দেশগলির মিলিত প্রচেষ্টা।
যে পরিমাণে ব্যক্তির উপর অন্য ব্যক্তির শোষণ শেষ করা যাবে, সেই অনুপাতে এক জাতি কর্তৃক অপর জাতির শোষণটাও বন্ধ হয়ে আসবে। যে পরিমাণে জাতির মধ্যে শ্রেণীবিরোধ শেষ হবে, সেই অনুপাতে এক জাতির প্রতি অন্য জাতির শত্ৰতাও মিলিয়ে যাবে।
ধম, দর্শন এবং সাধারণ ভাবার্দশের দিক থেকে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয় তা গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হবারও যোগ্য নয়।
মানুষের বৈষয়িক অস্তিত্বের অবস্থা, সামাজিক সম্পর্ক ও সমাজ জীবনের প্রতিটি বদলের সঙ্গে সঙ্গে তার ধারণা, মতামত ও বিশ্বাস, এককথায় মানুষের চেতনা যে বদলে যায়, একথা বুঝতে কি গভীর অন্তর্দৃষ্টি লাগে?
বৈষয়িক উৎপাদন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই অনুপাতে মানসিক সৃষ্টির প্রকৃতিতেও পরিবর্তন আসে, এছাড়া চিন্তার ইতিহাস আর কী প্রমাণ করে? প্রতি যুগেই যে সব ধারণা আধিপত্য করেছে তারা চিরকালই তখনকার শাসক শ্রেণীরই ধারণা।
লোকে যখন এমন ধারণার কথা বলে যা সমাজে বিপ্লব আনছে, তখন শুধু এই সত্যই প্রকাশ করা হয় যে পুরানো সমাজের মধ্যে নতুন এক সমাজের উপাদান সৃষ্টি হয়েছে, এবং অস্তিত্বের পুরানো অবস্থার ভাঙনের সঙ্গে সঙ্গে পুরানো ধারণার বিলোপ তাল রেখে চলছে।
প্রাচীন জগতের যখন অন্তিম অবস্থা, তখনই খৃষ্টান ধর্ম পুরানো ধর্মগুলিকে পরাস্ত করেছিল। খৃষ্টান ধারণা যখন আঠারো শতকে ব্যক্তিবাদী ধারণার কাছে হার মানে তখন সামন্ত সমাজেরও মৃত্যু সংগ্রাম চলেছিল সেদিনের বিপ্লবী বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে। ধর্মমতের স্বাধীনতা, বিবেকের মুক্তি শুধু জ্ঞানের রাজ্যে অবাধ প্রতিযোগিতার আধিপত্যটাকেই রূপ দিল।
বলা হবে যে ‘ঐতিহাসিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নিঃসন্দেহে ধর্মীয়, নৈতিক, দার্শনিক এবং আইনী ধারণাগলিতে পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু সে পরিবর্তন সত্ত্বেও নিয়ত টিকে থেকেছে ধর্ম, নৈতিকতা, দর্শন, রাজনীতি ও আইন।
‘তাছাড়া স্বাধীনতা, ন্যায়, ইত্যাদি চিরন্তন সত্য আছে, সমাজের সকল অবস্থাতেই তারা বিদ্যমান। কিন্তু কমিউনিজম চিরন্তন সত্যকেই উড়িয়ে দেয়, ধর্ম ও নৈতিকতাকে নতুন ভিত্তিতে পুনর্গঠিত না করে তা সব ধর্ম ও সম নৈতিকতারই উচ্ছেদ করে; তাই তা ইতিহাসের সকল অতীত অভিজ্ঞতার পরিপন্থী।’
এই অভিযোগ কোথায় এসে দাঁড়ায়? সকল অতীত সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণীবিরোধের বিকাশ, বিভিন্ন যুগে সে বিরোধ ভিন্ন ভিন্ন রূপে পরিগ্রহ করেছে।
কিন্তু যে রূপেই নিক একটা ব্যাপার অতীতের সকল যাগেই বৰ্তমান যথা, সমাজের এক অংশ কর্তৃক অপর অংশকে শোষণ। তাই এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে অতীত যুগের সামাজিক চেতনায় যত বিভিন্নতা ও বিচিত্রতাই প্রকাশ পাক না কেন, তা কয়েকটি নির্দিষ্ট সাধারণ রূপ বা সাধারণ ধারণার মধ্যেই আবদ্ধ থেকেছে, শ্রেণীবিরোধের সম্পূর্ণ লুপ্তির আগে তা পুরোপুরি অদৃশ্য হতে পারে না।
কমিউনিস্ট বিপ্লব হল চিরাচরিত সম্পত্তি সম্পর্কের সঙ্গে একেবারে আমূল বিচ্ছেদ; এই বিপ্লবের বিকাশে যে চিরাচরিত ধাবণার সঙ্গেও একেবারে আমূল একটা বিচ্ছেদ নিহিত, তাতে আর আশ্চর্য কি।
কিন্তু কমিউনিজমের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া আপত্তির প্রসঙ্গ যাক।
আগে আমরা দেখেছি যে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবে প্রথম ধাপ হল প্রলেতারিয়েতকে শাসক শ্রেণীর পদে উন্নীত করা, গণতন্ত্রের সংগ্রামকে জয়যক্ত করা।
বুর্জোয়াদের হাত থেকে ক্ৰমে ক্রমে সমস্ত পুঁজি কেড়ে নেওয়ার জন্য, রাষ্ট্র অর্থাৎ শাসক শ্রেণী রূপে সংগঠিত প্রলেতারিয়েতের হাতে উৎপাদনের সমস্ত উপকরণ কেন্দ্রীভূত করার জন্য এবং উৎপাদন-শক্তির মোট সমষ্টিটাকে যথাসম্ভব দ্রুত গতিতে বাড়িয়ে তোলার জন্য প্রলেতারিয়েত তার রাজনৈতিক আধিপত্য ব্যবহার করবে।
শুরুতে অবশ্যই সম্পত্তির অধিকার এবং বুর্জোয়া উৎপাদন পরিস্থিতির উপর স্বৈরাচারী আক্রমণ ছাড়া এ কাজ সম্পন্ন হতে পারে না; সুতরাং তা করতে হবে এমন সব ব্যবস্থা মারফত যা অর্থনীতির দিক থেকে অপষপ্ত ও অযৌক্তিক মনে হবে, কিন্তু যাত্রাপথে এরা নিজ সীমা ছাড়িয়ে যাবে এবং পুরানো সমাজ ব্যবস্থার উপর আরও আক্রমণ প্রয়োজনীয় করে তুলবে; উৎপাদন-পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিপ্লবীকরণের উপায় হিসাবে যা অপরিহার্য।