সমাজের উৎপন্ন জিনিসে দখলির অধিকার থেকে কমিউনিজম কোনও লোককে বঞ্চিত করে না; দখলির মাধ্যমে অপরের পরিশ্রমকে করায়ত্ত করার ক্ষমতাটাই সে কেবল হরণ করে।
আপত্তি উঠেছে যে ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ হলে সমস্ত কাজ বন্ধ হয়ে যাবে, সর্বব্যাপী আলস্য আমাদের অভিভূত করবে।
এই মত ঠিক হলে বহুপূর্বেই নিছক আলস্যের টানে বুর্জোয়া সমাজের রসাতলে যাওয়া উচিত ছিল, কারণ ও-সমাজে যারা খাটে তারা কিছু অর্জন করে না, আর যারা সবকিছু পায়, তাদের খাটতে হয় না। সমস্ত আপত্তিটাই অন্য ভাষায় এই পুনরুক্তির সামিল : যখন পুঁজি থাকবে না তখন মজুরি-শ্রমও অদৃশ্য হবে।
বৈষয়িক দ্রব্যের উৎপাদন ও দখলি বিষয়ে কমিউনিস্ট পদ্ধতির বিরুদ্ধে যত আপত্তি আনা হয়, মানসিক সৃষ্টির উৎপাদন ও দখলি সম্পর্কে কমিউনিস্ট পদ্ধতির বিরুদ্ধেও ঠিক সেই আপত্তি তোলা হয়। বুর্জোয়ার কাছে শ্রেণীগত মালিকানার উচ্ছেদটা যেমন উৎপাদনেরই অবসান বলে মনে হয়, তেমনি শ্রেণীগত সংস্কৃতির লোপ তার কাছে সকল সংস্কৃতি লোপ পাওয়ার সমার্থক।
যে সংস্কৃতির অবসান ভয়ে বুর্জোয়ারা বিলাপ করে, বিপুল সংখ্যাধিক জনগণের কাছে তা যন্ত্র হিসাবে কাজ করার একটা তালিম মাত্র।
বুর্জোয়া মালিকানা উচ্ছেদে আমাদের সংকল্পের বিচারে যদি আপনারা স্বাধীনতা, সংস্কৃতি, আইন, ইত্যাদির বুর্জোয়া ধারণার আশ্রয় নেন তাহলে আমাদের সঙ্গে তর্ক করতে আসবেন না। আপনাদের ধারণাগুলিই যে আপনাদের বুর্জোয়া উৎপাদন ও বুর্জোয়া মালিকানার পরিস্থিতি থেকেই উদ্ভূত, ঠিক যেমন আপনাদের শ্রেণীর ইচ্ছাটা সকলের উপর আইন হিসাবে চাপিয়ে দেওয়াটাই হল আপনাদের আইনশাস্ত্র, আপনাদের এ ইচ্ছাটার মূল প্রকৃতি ও লক্ষ্যও আবার নির্ধারিত হচ্ছে আপনাদের শ্রেণীরই অস্তিত্বের অর্থনৈতিক অবস্থা দ্বারা।
আপনাদের বর্তমান উৎপাদন-পদ্ধতি ও সম্পত্তির রূপ থেকে যে সামাজিক রূপে মাথা তোলে, ঐতিহাসিক এই যে সম্পর্ক উৎপাদনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উদয় ও লয় পায়, আত্মপর বিভ্ৰান্তির ফলে আপনারা তাকে প্রকৃতি ও বিচারবদ্ধির চিরন্তন নিয়মে রূপান্তরিত করতে চান, আপনাদের আগে যত শাসক শ্রেণী এসেছে তাদের সকলেরই ছিল অনুরূপ বিভ্ৰান্তি। প্রাচীন সম্পত্তির ক্ষেত্রে যে কথাটা আপনাদের কাছে পরিষ্কার, সামন্ত সম্পত্তির বেলায় যা আপনারা মেনে নেন, আপনাদের নিজস্ব বুর্জোয়া ধরনের সম্পত্তির ক্ষেত্রে অবশ্যই সে কথা আপনাদের স্বীকার করা বারণ।
পরিবারের উচ্ছেদ! উগ্র চরমপন্থীরা পৰ্যন্ত কমিউনিস্টদের এই গর্হিত প্রস্তাবে ক্ষেপে ওঠে।
আধুনিক পরিবার অর্থাৎ বুর্জোয়া পরিবারের প্রতিষ্ঠা কোন ভিত্তির উপর? সে ভিত্তি হল পুঁজি, ব্যক্তিগত লাভ। এই পরিবারের পূর্ণ বিকশিত রূপটি শুধু বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যেই আবদ্ধ। কিন্তু এই অবস্থারই অনুপূরণ দেখা যাবে প্রলেতারীয়দের পক্ষে পরিবারের কার্যত অনুপস্থিতিতে এবং প্রকাশ্য পতিতাবৃত্তির ভিতর।
অনুপূরক এই অবস্থার অবসানের সঙ্গে সঙ্গে বুর্জোয়া পরিবারের লোপও অবশ্যম্ভাবী, পুঁজির উচ্ছেদের সঙ্গেই আসবে উভয়ের অন্তর্ধান।
আমাদের বিরদ্ধে কি এই অভিযোগ যে সন্তানের উপর পিতামাতার শোষণ শেষ করে দিতে চাই? এ দোষ আমরা অস্বীকার করব না।
কিন্তু আপনারা বলবেন যে আমরা সবচেয়ে পবিত্র সম্পর্ক ধ্বংস করে দিই যখন আমরা পারিবারিক শিক্ষার স্থানে বসাই সামাজিক শিক্ষাকে।
আর আপনাদের শিক্ষাটা! সেটাও কি সামাজিক নয়? সামাজিক যে অবস্থার আওতায় শিক্ষাদান চলে তা দিয়ে, সমাজের সাক্ষাৎ কিংবা অপ্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ মারফত, স্কুল ইত্যাদির মাধ্যমে কি সে শিক্ষা নিয়ন্ত্রিত হয় না? শিক্ষা ব্যাপারে সমাজের হস্তক্ষেপ কমিউনিস্টদের উদ্ভাবন নয়; তারা চায় শুধু হস্তক্ষেপের প্রকৃতিটা বদলাতে, শাসক শ্রেণীর প্রভাব থেকে শিক্ষাকে উদ্ধার করতে।
আধুনিক যন্ত্রশিল্পের ক্রিয়ায় মজুরদের মধ্যে সকল পারিবারিক বন্ধন যত বেশি মাত্রায় ছিন্ন হতে থাকে, তাদের ছেলেমেয়েরা যত বেশি করে সামান্য কেনাবেচার বস্তু ও পরিশ্রমের হাতিয়ারে পরিণত হতে থাকে, ততই পরিবার ও শিক্ষা বিষয়ে বাপ-মার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের পবিত্র সম্বন্ধ বিষয়ে বুর্জোয়াদের বাগাড়ম্বর ঘৃণ্য হয়ে ওঠে।
সমস্ত বুর্জোয়া শ্রেণী সমস্বরে চীৎকার করে বলে–কিন্তু তোমরা কমিউনিস্টরা যে মেয়েদের সাধারণ সম্পত্তি করে ফেলতে চাও।
বুর্জোয়া নিজের স্ত্রীকে নিতান্ত উৎপাদনের হাতিয়ার হিসাবেই দেখে থাকে। তাই যখন সে শোনে যে উৎপাদনের হাতিয়ারগুলি সমবেতভাবে ব্যবহার করার কথা উঠেছে, তখন সমবেতভাবে মেয়েদের ভাগ্যেও তেমনি সকলের ভোগ্য হতে হবে, এছাড়া আর কোনও সিদ্ধান্তে সে আসতে পারে না।
ঘুণাক্ষরেও তার মনে সন্দেহ জাগে না যে আসল লক্ষ্য হল উৎপাদনের হাতিয়ার মাত্র হয়ে থাকার দশা থেকে মেয়েদের মুক্তিসাধন।
তাছাড়া, মেয়েদের উপর এই সাধারণ অধিকারটা কমিউনিস্টরা প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করবে এই ভান করে আমাদের বুর্জোয়ারা যে এত ধর্মক্রোধ দেখায় তার চেয়ে হাস্যাম্পদ আর কিছু নেই। মেয়েদের সাধারণ সম্পত্তি করার প্রয়োজন কমিউনিস্টদের নেই; প্রায় স্মরণাতীতকাল থেকে সে প্রথার প্রচলন আছে।
সামান্য বেশ্যার কথা না হয় ছেড়ে দেওয়াই হল, মজুরদের স্ত্রী-কন্যা হাতে পেয়েও আমাদের বুর্জোয়ারা সন্তুষ্ট নয়, পরস্পরের স্ত্রীকে ফুঁসলে আনাতেই তাদের পরম আনন্দ!