আমাদের বিরুদ্ধে–কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে–অভিযোগ আনা হয়েছে যে, ব্যক্তিবিশেষের নিজ পরিশ্রমের ফল হিসাবে নিজস্ব সম্পত্তি অর্জনের অধিকারের আমরা উচ্ছেদ করতে চাই, বলা হয় যে, সকল ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, কর্ম ও স্বাবলম্বনের মূলভিত্তি হল এই সম্পত্তি।
কষ্টলন্ধ, সর্বাধিকৃত, স্বেপার্জিত সম্পত্তি! সামান্য কারিগর ও ক্ষুদে চাষীর সম্পত্তির কথাই কি বলা হচ্ছে, যে ধরনের সম্পত্তি ছিল বুর্জোয়া সম্পত্তির আগে? তাকে উচ্ছেদ করার কোন প্রয়োজন নেই; যন্ত্রশিল্পের বিকাশ ইতিমধ্যেই তাকে অনেকাংশে ধ্বংস করেছে, এখনও প্রতিদিন ধ্বংস করে চলেছে।
নাকি বলা হচ্ছে আধুনিক বুর্জোয়া ব্যক্তিগত মালিকানার কথা?
কিন্তু মজুরি-শ্রম কি মজুরদের জন্য কোনো মালিকানা সৃষ্টি করে? একেবারেই না। সে সৃষ্টি করে পুঁজি, অর্থাৎ সেই ধরনের সম্পত্তি যা মজুরি-শ্রমকে শোষণ করে, নিত্য নতুন শোষণের জন্য নতুন নতুন মজুরি-শ্রমের সরবরাহ সৃষ্টির শর্ত ছাড়া যা বাড়তে পারে না। বর্তমান ধরনের এই মালিকানা পুঁজি ও মজুরি-শ্রমের বিরোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। বিরোধের দুইটি দিকই পরীক্ষা করে দেখা যাক।
পুঁজিপতি হওয়া মানে উৎপাদন-ব্যবস্থার মধ্যে শুধু একটা ব্যক্তিগত নয়, একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। পুঁজি একটা যৌথ সৃষ্টি; সমাজের অনেক লোকের মিলিত কাজের ফলে, এমন কি শেষ বিশ্লেষণে, সমাজের সকল লোকের মিলিত কমেই পুঁজিকে চালু করা যায়।
পুঁজি তাই ব্যক্তিগত নয়, একটা সামাজিক শক্তি।
কাজেই পুঁজিকে সাধারণ সম্পত্তিতে অর্থাৎ সমাজের সকল লোকের সম্পত্তিতে পরিণত করলে, তার দ্বারা ব্যক্তিগত সম্পত্তি সামাজিক সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয় না। মালিকানার সামাজিক রূপটাই কেবল বদলে যায়। তার শ্রেণীগত প্রকৃতিটা লোপ পায়।
এবার মজুরি-শ্রমের কথা ধরা যাক।
মজুরি-শ্রমের গড়পড়তা দাম হল নিম্নতম মজুরি, অর্থাৎ মেহনতী হিসাবে মেহনতীর মাত্র অস্তিত্বটুকু বজায় রাখার জন্য যা একান্ত আবশ্যক, গ্রাসাচ্ছাদনের সেইটুকু উপকরণ। সুতরাং মজুরি-শ্রমিক শ্রম করে যেটুকু ভাগ পায় তাতে কেবল কোনো ক্রমে এই অস্তিত্বটুকু চালিয়ে যাওয়া ও পুনরুৎপাদন করা চলে। শ্রমোৎপন্নের উপর এই ব্যক্তিগত দখলি, যা কেবল মানুষের প্রাণরক্ষা ও নতুন মানুষের জন্মদানের কাজে লাগে এবং অপরের পরিশ্রমের উপর কর্তৃত্ব চালাবার মতো কোনো উদ্বৃত্ত যার থাকে না, তেমন ব্যক্তিগত দখলির উচ্ছেদ একেবারেই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা কেবল উচ্ছেদ চাই দখলির এই শোচনীয় প্রকৃতিটার, যার ফলে শ্রমিক বাঁচে শুধু পুঁজি বাড়ানোর জন্য, তাকে বাঁচতে হয় শাসক শ্রেণীর স্বার্থসিদ্ধির জন্য যতটা প্রয়োজন ঠিক ততখানি পর্যন্ত।
বুর্জোয়া সমাজে জীবন্ত পরিশ্রম পূর্বসঞ্চিত পরিশ্রম বাড়াবার উপায়মাত্র। কমিউনিস্ট সমাজে কিন্তু পূর্বসঞ্চিত পরিশ্রম শ্রমিকের অস্তিত্বকে উদারতর, সমদ্ধতির, উন্নততর করে তোলার উপায়।
সুতরাং বুর্জোয়া সমাজে বর্তমানের উপর আধিপত্য করে অতীত; কমিউনিস্ট সমাজে বর্তমান আধিপত্য করে অতীতের উপর। বুর্জোয়া সমাজে পুঁজি হল স্বাধীন, স্বতন্ত্র-সত্তা, কিন্তু জীবন্ত মানুষ হল পরাধীন, স্বতন্ত্র-সত্তাবিহীন।
অথচ এমন অবস্থার অবসানকেই বুর্জোয়ারা বলে স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উচ্ছেদ! কথাটা সত্যই। বুর্জোয়া ব্যক্তিত্ব, বুর্জোয়া স্বাতন্ত্র্য, বুর্জোয়া স্বাধীনতার উচ্ছেদই যে আমাদের লক্ষ্য তাতে সন্দেহ নেই।
উৎপাদনের বর্তমান বুর্জোয়া ব্যবস্থায় স্বাধীনতার অর্থ হল অবাধ বাণিজ্য, অবাধে বেচাকেনার অধিকার।
কিন্তু যদি বেচাকেনাই লোপ পায়, তবে অবাধ বেচাকেনাও অন্তর্ধান করবে। এই অবাধ বেচাকেনার কথাটা এবং সাধারণভাবে স্বাধীনতা সম্বন্ধে আমাদের বুর্জোয়াদের অন্য সব ‘আস্ফালনের’ যদি কোনো অর্থ থাকে। তবে সে শুধু সীমাবদ্ধ কেনাবেচার সঙ্গে তুলনায়, মধ্যযুগীয় বাধাগ্রস্ত বণিকদের সঙ্গে তুলনায়; কেনাবেচার, উৎপাদনের বুর্জোয়া শর্ত ও খোদ বুর্জোয়া শ্রেণীটোরই যে উচ্ছেদের কথা কমিউনিস্টরা বলে তার কাছে এগুলির কোনো অর্থ টেকে না।
আমরা ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান চাই শনে আপনারা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। অথচ আপনাদের বর্তমান সমাজে জনগণের শতকরা নব্বই জনের ব্যক্তিগত মালিকানা তো ইতিমধ্যেই লোপ পেয়েছে; অল্প কয়েকজনের ভাগ্যে সম্পত্তির একমাত্র কারণ হল ঐ দশ ভাগের নয় ভাগ লোকের হাতে কিছুই না থাকা। সুতরাং আমাদের বিরুদ্ধে আপনাদের অভিযোগ দাঁড়ায় এই যে সম্পত্তির অধিকারের এমন একটা রূপে আমরা তুলে দিতে চাই যা বজায় রাখার অনিবাৰ্য শর্ত হল সমাজের বিপুল সংখ্যাধিক লোকের সম্পত্তি না থাকা।
এককথায়, আমাদের সম্বন্ধে আপনাদের অভিযোগ এই যে আপনাদের সম্পত্তির উচ্ছেদ আমরা চাই। ঠিক কথা, আমাদের সংকল্প ঠিক তা-ই।
যেই মানুষের পরিশ্রমকে আর পুঁজি, মুদ্রা, অথবা খাজনাতে পরিণত করা চলে না, একচেটিয়া কর্তৃত্বের মুঠির আয়ত্তাধীন একটা সামাজিক শক্তিতে পরিণত করা অসম্ভর হয়ে পড়ে–অর্থাৎ যেই ব্যক্তিগত মালিকানা আর বুর্জোয়া মালিকানায়, পুঁজিতে রূপান্তরিত হতে পারে না, তখনি আপনারা বলেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য শেষ হয়ে গেল।
তাহলে স্বীকার করুন যে ‘ব্যক্তি’ বলতে বুর্জোয়া ছাড়া, শুধু মধ্য শ্রেণীভুক্ত সম্পত্তির মালিক ছাড়া অন্য লোক বোঝায় না। এহেন ব্যক্তিকে অবশ্যই পথ থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় দিতে হবে, তার অস্তিত্ব করে তুলতে হবে অসম্ভব।