পুরানো সমাজের নিম্নতম স্তর থেকে ছিটকে-পড়া যে সব লোক নিষ্ক্রিয়ভাবে পচছে, সেই সামাজিক আবিজানাটাকে, সেই বিপজ্জনক শ্রেণীকে শ্রমিক বিপ্লব এখানে ওখানে আন্দোলনের মধ্যে ঝোঁটিয়ে নিয়ে আসতে পারে; কিন্তু এদের জীবনযাত্রার ধরনটা এমনই যে তা প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্রের ভাড়াটে হাতিয়ারের ভূমিকার জন্যই তাদের অনেক বেশি তৈরি করে তোলে।
পুরানো সমাজের সাধারণ পরিস্থিতিটা প্রলেতারিয়েতের জীবনে ইতিমধ্যেই প্রায় লোপ পেতে বসেছে। প্রলেতারিয়েতের সম্পত্তি নেই; স্ত্রী-পুত্ৰ-কন্যার সঙ্গে তার যা সম্বন্ধ সেটা আর বুর্জোয়া পারিবারিক সম্বন্ধের সঙ্গে মেলে না; আধুনিক শিল্পশ্রম, পুঁজির কাছে আধুনিক ধরনের অধীনতা, যা ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স, আমেরিকা অথবা জার্মানিতে একই প্রকার, তাতে তার জাতীয় চরিত্রের সমস্ত বৈশিস্টাই লোপ পেয়েছে। তার কাছে আইন, নীতি, ধর্ম হল কয়েকটা বুর্জোয়া কুসংস্কার মাত্র যার পিছনে ওঁৎ পেতে আছে বুর্জোয়া স্বার্থ।
অতীতের যে সব শ্রেণী কর্তৃত্ব পেয়েছে তারা সবাই অর্জিত প্রতিষ্ঠা দৃঢ়তর করতে চেয়েছে গোটা সমাজের ওপর তাদের দখলির শর্তটা চাপিয়ে দিয়ে। প্রলেতারিয়েতের পক্ষে তাদের দখলির নিজস্ব পর্বতন পদ্ধতি উচ্ছেদ না করে এবং তাতে করে দখলির প্রত্যেকটি ভুতপূর্ব পদ্ধতির অবসান না ঘটিয়ে, সমাজের উৎপাদনশক্তির উপর প্রভুত্ব লাভ সম্ভব নয়। তাদের নিজস্ব বলতে এমন কিছু নেই যাকে রক্ষা অথবা দঢ়তর করতে হবে; ব্যক্তিগত মালিকানার সমস্ত পূর্বতন নিরাপত্তা ও নিশ্চিতি নির্মূল করে দেওয়াই তাদের ব্ৰত।
অতীত ইতিহাসে প্রতিটি আন্দোলন ছিল সংখ্যালেপির দ্বারা অথবা সংখ্যালেপির স্বার্থে আন্দোলন। প্রলেতারীয় আন্দোলন হল বিরাট সংখ্যাধিকের স্বার্থে বিপুল সংখ্যাধিকের আত্মসচেতন সর্বাধীন আন্দোলন। প্রলেতারিয়েত আজকের সমাজে নিম্নতম অন্তর; তাকে নড়তে হলে, উঠে দাঁড়াতে হলে, উপরে চাপানো সরকারী সমাজের গোটা স্তরটিকে শূন্যে উৎক্ষিপ্ত না করে উপায় নেই।
বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরদ্ধে প্রলেতারিয়েতের লড়াইটা মর্মবস্তুতে না হলেও আকারের দিক থেকে হল প্রথমত জাতীয় সংগ্রাম। প্রত্যেক দেশের প্রলেতারিয়েতকে অবশ্যই সর্বাগ্রে ফয়সালা করতে হবে স্বদেশী বুর্জোয়াদের সঙ্গে।
প্রলেতারিয়েতের বিকাশের সাধারণতম পৰ্যায়গুলির ছবি আঁকতে গিয়ে আমরা দেখিয়েছি যে বৰ্তমান সমাজের ভিতরে কমবেশি প্রচ্ছন্ন গৃহযুদ্ধ চলেছে, যে যুদ্ধ একটা বিন্দুতে এসে প্রকাশ্য বিপ্লবে পরিণত হয় এবং তখন বুর্জোয়াদের সবলে উচ্ছেদ করে স্থাপিত হয় প্রলেতারিয়েতের আধিপত্যের ভিত্তি।
আমরা আগেই দেখেছি যে আজ পর্যন্ত সব ধরনের সমাজ গড়ে উঠেছে অত্যাচারী ও অত্যাচারিত শ্রেণীর বিরোধের ভিত্তিতে। কিন্তু কোনো শ্রেণীর উপর অত্যাচার বজায় রাখতে হলে তার জন্য এমন কিছুটা অবস্থা নিশ্চিত করতে হয় যাতে সে তার দাসোচিত অস্তিত্বটুকু অন্তত চালিয়ে যেতে পাবে। ভূমিদাসত্বের যুগে ভূমিদাস নিজেকে কমিউন-সভ্যের পর্যায়ে তুলেছিল ঠিক যেমন সামন্ত স্বৈরতন্ত্রের পেষণতলেও পেটি বুর্জোয়া পেরেছিল বুর্জোয়ারূপে বিকশিত হতে। পক্ষান্তরে, আধুনিক শ্রমিক কিন্তু যন্ত্রশিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উপরে ওঠে না, স্বীয় শ্রেণীর অস্তিত্বের যা শত, তারও নিচে ক্রমশই বেশি করে তাকে নেমে যেতে হয়। মজুর হয়ে পড়ে দুঃস্থ (pauper), আর দুঃস্থাবস্থা বেড়ে চলে জনসংখ্যা ও সম্পদবৃদ্ধির চেয়ে দ্রুততর তালে। এই সূত্রেই পরিষ্কার প্রতিপন্ন হয় যে বুর্জোয়া শ্রেণীর আর সমাজের শাসক হয়ে থাকার যোগ্যতা নেই, নিজেদের অস্তিত্বের শর্ত টাকে চরম আইন হিসাবে সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে রাখার অধিকার নেই। বুর্জোয়া শ্রেণী-শাসন চালাবার উপযক্ত নয়, কারণ তারা দাসত্বের মধ্যে দাসের অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে অক্ষম, তাদের এমন অবস্থায় না নামিয়ে পারে না যেখানে দাসের দৌলতে খাওয়ার বদলে দাসকেই খাওয়াতে হয়। এই বুর্জোয়ার শাসনে সমাজ আর বেচে থাকতে পারে না, অর্থাৎ অন্য ভাষায় বলতে গেলে তার অস্তিত্ব আর সমাজের সঙ্গে খাপ খায় না।
বুর্জোয়া শ্রেণীর অস্তিত্ব ও আধিপত্যের মূলশর্ত হল পুঁজির সৃষ্টি ও বৃদ্ধি; পুঁজির শর্ত হল মজুরি-শ্রম। মজুরি-শ্রম সম্পূর্ণভাবে মজুরদের মধ্যেকার প্রতিযোগিতার উপর প্রতিষ্ঠিত। যন্ত্রশিল্পের যে অগ্রগতি বুর্জোয়া শ্রেণী না ভেবেই বাড়িয়ে চলে, তার ফলে শ্রমিকদের প্রতিযোগিতা-হেতু বিচ্ছিন্নতার জায়গায় আসে। সম্মিলন-হেতু বিপ্লবী ঐক্য। সুতরাং, যেভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে বুর্জোয়া শ্রেণী উৎপাদন করে ও উৎপন্ন দখল করে, আধুনিক শিল্পের বিকাশ তার পায়ের তলা থেকে সেই ভিত্তিটাই কেড়ে নিচ্ছে। তাই বুর্জোয়া শ্রেণী সৃষ্টি করছে সর্বোপরি তারই সমাধি-খনকদের। বুর্জোয়ার পতন এবং প্রলেতারিয়েতের জয়লাভ, দুইই সমান অনিবার্য।র
—————
1) বুর্জোয়া বলতে আধুনিক পুঁজিপতি শ্রেণী বোঝায়, যারা সামাজিক উৎপাদনের উপায়গুলির মালিক এবং মজুরি-শ্রমের নিয়োগকর্তা। প্রলেতারিয়েত হল আজকালকার মজুরি-শ্রমিকেরা, উৎপাদনের উপায় নিজেদের হাতে না থাকার দরুন যারা বেঁচে থাকার জন্য স্বীয় শ্রমশক্তি বেচতে বাধ্য হয়। (১৮৮৮ সালের ইংরেজী সংস্করণে এঙ্গেলসের টীকা।)