কিন্তু যন্ত্রশিল্প প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণী কেবল সংখ্যায় বাড়ে না; তারা কেন্দ্ৰীভূত হতে থাকে বৃহত্তর সমষ্টিতে, তাদের শক্তি বাড়তে থাকে, আপন শক্তি তারা বেশি করে উপলব্ধি করে। কলকারখানা যে অনুপাতে বিভিন্ন ধরনের শ্রমের পার্থক্য মুছে ফেলতে থাকে আর প্রায় সর্বত্র মজুরি কমিয়ে আনে একই নিচু স্তরে, সেই অনুপাতে প্রলেতারিয়েত বাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন স্বার্থ ও জীবনযাত্রার অবস্থা ক্রমেই সমান হয়ে যেতে থাকে। বুর্জোয়াদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা এবং তৎপ্রসূত বাণিজ্যসংকটে শ্রমিকের মজুরি হয় আরও বেশি দোদুল্যমান। যন্ত্রের অবিরাম উন্নতি ক্রমেই আরো দ্রুততালে বাড়তে থাকে, মজুরের জীবিকা হয়ে পড়ে আরও বিপন্ন; এক একদল মজুরের সঙ্গে এক একজন বুর্জোয়ার সংঘর্ষ ক্রমেই বেশি করে দুই শ্রেণীর দ্বন্দ্বের রূপ নেয়। তখন মজুরেরা মিলিত সমিতি গঠন শুরু করে (ট্রেড ইউনিয়ন) বুর্জোয়ার বিরুদ্ধে; মজুরির হার বজায় রাখার জন্য জোট বাঁধে; মাঝে মধ্যে ঘটা এই বিদ্রোহের আগে থাকতে প্রস্তুতির জন্য স্থায়ী সংগঠন গড়ে। এখানে ওখানে দ্বন্দ্ব পরিণত হয় অভ্যুত্থানে।
মাঝে মাঝে শ্রমিকেরা জয়ী হয়, কিন্তু কেবল অল্পদিনের জন্য। তাদের সংগ্রামের আসল লাভ আশু ফলাফলে নয়, মজুরদের ক্রমবর্ধমান একতায়। এই একতার সহায় হয় যোগাযোগের উন্নত ব্যবস্থা, আধুনিক শিল্প যার সৃষ্টি করেছে এবং যার মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার মজুরেরা পরস্পরের সংস্পর্শে আসে। একজাতীয় অসংখ্য স্থানীয় লড়াইকে দেশব্যাপী এক শ্রেণী-সংগ্রামে কেন্দ্ৰীভূত করার জন্য ঠিক এই সংযোগটারই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু প্রত্যেকটা শ্রেণী-সংগ্রামই হল রাজনৈতিক সংগ্রাম। শোচনীয় রাস্তাঘাটের দরন যে ঐক্য আনতে মধ্যযুগের নাগরিকদের শতাব্দীর পর শতাব্দী লেগেছিল, আধুনিক শ্রমিকরা তা অর্জন করে রেলপথের কল্যাণে মাত্র কয়েক বছরে।
মজুরদের পরস্পরের মধ্যেই প্রতিযোগিতা আবার তাদের শ্রেণী হিসাবে সংগঠিত। হওয়া এবং তার ফলে এক রাজনৈতিক দলে পরিণত হওয়াকে প্রতিক্ষণে ব্যৰ্থ করে দেয়। কিন্তু প্রতিবারই প্রবলতর, দঢ়তর, আরও শক্তিশালী হয়ে সংগঠন মাথা তোলে। এরই চাপে বুর্জোয়াদের মধ্যে বিভেদের ফলে শ্রমিকদের এক একটা স্বার্থকে আইনত মেনে নিতে হয়। ইংলন্ডে দশ ঘণ্টার আইন এই ভাবে পাশ হয়েছিল।
মোটের উপর, পুরনো সমাজের নানা শ্রেণীর মধ্যে সংঘাত প্রলেতারিয়েতের বিকাশে নানাভাবে সাহায্য করে। বুর্জোয়া শ্রেণীকে লিপ্ত থাকতে হয় অবিরাম সংগ্রামে। প্রথমে লড়াই হয় অভিজাতদের সঙ্গে; পরে বুর্জোয়া শ্রেণীরই যে যে অংশের স্বার্থ যন্ত্রশিল্প বিস্তারের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় তাদের বিরুদ্ধে; আর সর্বদাই বিদেশের বুর্জোয়াদের বিরদ্ধে। এইসব সংগ্রামেই বুর্জোয়াদের বাধ্য হয়ে শ্রমিক শ্রেণীর কাছে আবেদন করতে হয়, সাহায্য চাইতে হয় তাদেরই কাছে, তাদের টেনে আনতে হয় রাজনীতির প্রাঙ্গণে। সুতরাং বুর্জোয়ারা নিজেরাই প্রলেতারিয়েতকে তাদের রাজনৈতিক ও সাধারণ শিক্ষার কিছুটা জোগাতে থাকে; অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়বার অস্ত্র প্রলেতারিয়োতকে তারাই জোগায়।
এছাড়া আমরা আগেই দেখেছি যে শিল্পের অগ্রগতির ফলে শাসক শ্রেণীর মধ্য থেকে গোটাগুটি এক একটা অংশ প্রলেতারিয়েতের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হতে থাকে, তাদের জীবনযাত্রার অবস্থা অন্তত বিপন্ন হয়। এরাও আবার প্রলেতারিয়োতকে জোগায় জ্ঞানলাভ ও প্রগতির নতুন নতুন উপাদান।
শেষপর্যন্ত শ্রেণী-সংগ্রাম যখন চড়ান্ত মুহূর্তের কাছে এসে পড়ে, তখন শাসক শ্রেণীর মধ্যে, বস্তুতপক্ষে পুরানো সমাজের গোটা পরিধি জুড়ে ভাঙ্গনের যে প্রক্রিয়া চলেছে তা এমন একটা প্রখর হিংস্র রূপে নেয় যে শাসক শ্রেণীর একটা ছোট অংশ পর্যন্ত ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে, হাত মেলায় বিপ্লবী শ্রেণীর সঙ্গে, সেই শ্রেণীর সঙ্গে যার হাতেই ভবিষ্যৎ। সুতরাং আগেকার একযুগে যেমন অভিজাতদের একটা অংশ বুর্জোয়া শ্রেণীর দিকে চলে গিয়েছিল, ঠিক তেমনই এখন বুর্জোয়াদের একটা ভাগ যোগ দেয়। শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে, বিশেষ করে বুর্জোয়া ভাবাদর্শীদের কিছু কিছু, যারা ইতিহাসের সমগ্র গতিকে তত্ত্বের দিক থেকে বুঝতে পারার স্তরে নিজেদের তুলতে পেরেছে।
আজকের দিনে বুর্জোয়াদের মুখোমুখি যেসব শ্রেণী দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে শুধু প্রলেতারিয়েত হল প্রকৃত বিপ্লবী শ্রেণী। অপর শ্রেণীগুলি আধুনিক যন্ত্রশিল্পের সামনে ক্ষয় হতে হতে লোপ পায়; প্রলেতারিয়েত হল সেই যন্ত্রশিল্পের বিশিষ্ট ও অপরিহার্য সৃষ্টি।
নিম্ন মধ্যবিত্ত, ছোট হস্তশিল্প কারখানার মালিক, দোকানদার, কারিগর চাষী — এরা সকলে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়ে মধ্য শ্রেণীর টুকরো হিসাবে নিজেদের অস্তিত্বটাকে ধ্বংসের মুখ থেকে বাঁচাবার জন্য। তাই তারা বিপ্লবী নয়, রক্ষণশীল। বলতে গেলে প্রতিক্রিয়াশীলও, কেন না ইতিহাসের চাকা পিছনে ঘোরাবার চেষ্টা করে তারা। দৈবক্রমে যদি এরা বিপ্লবী হয় তবে তা হয় কেবল তাদের প্রলেতারিয়েত রূপে আসন্ন রূপান্তরের কারণে; সুতরাং তারা তখন রক্ষা করে তাদের বৰ্তমান সবাৰ্থ নয়, ভবিষ্যৎ স্বার্থ; নিজস্ব দন্টিভঙ্গি ত্যাগ করে তারা গ্ৰহণ করে। প্রলেতারিয়েতের দৃষ্টিভঙ্গি।