মহবত খান, আমরা আগেই একমত হয়েছি যে প্রতিপক্ষের গুলিবর্ষণের মাঝে নদী অতিক্রমের ব্যাপারটা জড়িত থাকায় সামনাসামনি আক্রমণ করলে আমাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হবে, কিন্তু আপনি আমাদের কোথায় রাভি অতিক্রম করার পরামর্শ দেবেন?
‘আমি লাহোরের উজানে আর ভাটিতে দুই স্থানে নদী পার হবার পরামর্শ দেবো যাতে উভয়দিক থেকে একসাথে আমরা শহর আক্রমণ করতে পারি। আমরা ইতিমধ্যে দুটো সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত সংখ্যক নৌকা আর পাটাতন সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি।’
‘মহবত খান আপনার পরিকল্পনাটা ভালোই, কিন্তু আমরা কত দ্রুত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে পারবো?
‘একরাতে।
‘আপনি বলতে চাইছেন আমি যদি এই মুহূর্তে আদেশ দেই তাহলে সকালবেলায় আমরা আক্রমণ করতে পারবো?
‘হা। আমাদের লোকেরা ভালোমত প্রশিক্ষিত এবং আমাদের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আর অন্যান্য অনুষঙ্গ মালবাহী শকটের বহর থেকে ইতিমধ্যে নামিয়ে নেয়া হয়েছে।’
‘বেশ তাহলে, দিনটা আগামীকালই হোক। আমি যদি ভাটির পারাপারের নেতৃত্ব দেই তাহলে আপনি কি উজানের পারাপারের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন?
‘অবশ্যই।
‘কিন্তু খুররম আক্রমণকারী দলের একটার নেতৃত্ব দিয়ে আপনার কি নিজেকে ঝুঁকির মাঝে ফেলা উচিত হবে? আপনি কি এখানে আমাদের গোলন্দাজদের তত্ত্বাবধান করে এবং সর্বময় নেতৃত্ব গ্রহণের মাধ্যমে কি অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবেন না?’ আসফ খান তাদের কথার মাঝে বলে।
‘পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক হতো তাহলে হয়তো আপনার কথাই ঠিক ছিল, কিন্তু এটা মোটেই স্বাভাবিক সময় না। আমি সম্রাট হবার সাথে সাথে একজন পিতাও বটে। মেহেরুন্নিসা আর শাহরিয়ার আমার দুই সন্তানকে বন্দি করে রেখেছে। আমি নিজে তাঁদের কাছে যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছাতে চাই। তোপচিদের নেতৃত্বের বিষয়ে আপনার উপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে, তারা যেন তাদের গোলাবর্ষণ প্রতিরক্ষা প্রাচীর আর কামানের মঞ্চের প্রতি নির্দিষ্ট রাখে এবং শাহরিয়ার আমার সন্তানদের–আপনার নাতিদের–বন্দি করে রাখতে পারে এমনসব স্থান পরিহার করে এই বিষয়টা কেবল নিশ্চিত করবেন।
*
পরের দিন খুব সকালবেলা খুররম লাহোরের আড়াই মাইল ভাটিতে রাভি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকে যখন তার লোকেরা কয়েকটা দলে বিভক্ত হয়ে স্থানীয় জেলেদের কাছ থেকে বড় অংকের পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দখল করা নৌকার ক্ষুদে বহরে সন্তপণে আরোহণ করতে শুরু করে। সৈন্যরা নিরবে বৈঠা পানিতে নামাতে থাকে এবং বেশির ভাগ নৌকার সাথে সংযুক্ত রিফু-করা এবং তপ্পি মারা সুতির একক পাল তুলে দেয়। সে তার লোকদের প্রথমে নদী পার হবার এবং শাহরিয়ারের বাহিনীর কাছ থেকে কোনো ধরনের প্রতিরোধের বিরুদ্ধে অবতরণের জায়গাটা নিরাপদ করার দায়িত্ব দিয়েছে এবং তারপরে আংশিক নির্মিত সেতুর একটা অংশ তাঁরা টেনে ওপারে নিয়ে যাবে এবং নিরাপদে সেটাকে ওপারে টেনে নিয়ে গিয়ে নোঙরের সাহায্যে নিরাপদ করে তার দিকের তীর থেকে ইতিমধ্যে বর্ধিত সেতুর অংশের সাথে যুক্ত করার জন্য প্রস্তুত করবে। তার লোকেরা রাতের বেলা যখন নদীর তীর বরাবর এগিয়ে এসে নৌকার সেতুর প্রাথমিক নির্মাণকাজ আরম্ভ করে তখন তারা কোনো ধরনের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় নি। সূর্যোদয়ের পরেও–সকালের কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের বুকে একটা কমলা গোলক–এমনকি দূরবর্তী তীরের পাড়ের দিকে নেমে আসা নিম্নমুখী নিচু মাটির ঢিবির মাঝেও শাহরিয়ারের বাহিনীর আগমনের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। অবশ্য, তার মানে এই নয় যে তারা অবতরণকারী দলকে অতর্কিতে আক্রমণের জন্য গোপনে ওঁত পেতে অপেক্ষা করছে না। বর্ষাকালে খুবই অল্প বৃষ্টিপাত হওয়ায়, বছরের এই সময়ের তুলনায় নদীতে অন্তত পানির স্তর অনেক নিচুই রয়েছে এবং নদীর পানি এই মুহূর্তে দুইশ ফিটের বেশি প্রশস্ত হবে না।
খুররম তাকিয়ে দেখে যে তীর থেকে নৌকার প্রথম বহরটা যাত্রা শুরু করেছে, বৈঠা হাতে মাঝিদের পিঠ ওঠানামা করছে। প্রতিটা নৌকায় দুই তিনজন করে তবকি গলুইয়ের কাছে শুয়ে গুলিবর্ষণের জন্য তাঁদের লম্বা-নলযুক্ত বন্দুক প্রস্তুত অবস্থায় রেখে ওপাড়ের তীর বরাবর আনত করে রেখেছে। স্রোতের বাধা সত্ত্বেও, যা এখনও বেশ প্রবল, কয়েক মিনিটের ভিতরেই প্রথম নৌকাটার–লাল রঙ করা বেশ বড় একটা নৌকা–সামনের অংশ তীরের দিকে অগ্রসর হতে থাকার সময়েও প্রতিপক্ষের সাথে কোনো মোকাবেলা হয় নি। কয়েকজন সৈন্য নৌকার ধারে টলমল করতে করতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, অগভীর পানিতে লাফিয়ে নেমে পানির ভিতর দিয়ে হেঁটে তীরে যাবার জন্য যখন খুররমের কানে পরপর কয়েকটা গুলির শব্দ ভেসে আসে। নৌকার একপাশে গুঁড়ি মেরে বসে থাকা লোকদের ভিতরে একজন পানি ছিটকে দিয়ে সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, পেছনে অবস্থানরত নৌকাগুলোয় আরো তিনজন তাকে অনুসরণ করে।
খুররম ঠিক যেমনটা সন্দেহ করেছিল, তীর থেকে প্রায় শ’খানেক গজ দূরে মাটির ঢিবিগুলোর একটার পেছন থেকে গুলি করা হয়েছে। গুলির পরপরই এক ঝাঁক তীর উড়ে আসে কিন্তু, তার মাথা ঝড়ের বেগে কাজ করতে শুরু করে, খুররম দেখে স্বস্তি পায় যে তীরের সংখ্যা ত্রিশের বেশি হবে না। স্পষ্টতই অপর তীরে শত্রুপক্ষের বড় কোনো বাহিনী ওঁত পেতে নেই। তার নিজের লোকেরা এখন তরবারি হাতে যত দ্রুত সম্ভব দৌড়াতে আরম্ভ করেছে এবং উন্মুক্ত তীরের উপর দিয়ে উপরের মাটির ঢিবির দিকে উঠে যাচ্ছে। তারা যখন প্রায় তিন চতুর্থাংশ পথ অতিক্রম করেছে তখন আরো গাদাবন্দুক ঢিবির পেছনের নিরাপদ স্থান থেকে বিচ্ছিন্নভাবে গর্জে উঠে এবং খুররমের বেশ কয়েকজন সৈন্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যাদের ভিতরে একেবারে সামনে বাঁকানো তরবারি আন্দোলিত করে ছুটতে থাকা–সবুজ আলখাল্লা পরিহিত দানবাকৃতির এক যোদ্ধাও রয়েছে। লোকটা অবশ্য কিছুক্ষণের ভিতরেই আবার উঠে দাঁড়িয়ে তার ঊর্ধ্বমুখী ধাওয়া শুরু করে, কিন্তু সে বা অন্যকেউ মাটির ঢিবির শীর্ষদেশে পৌঁছাবার আগেই খুররম একদল অশ্বারোহীকে দেখতে পায়–সম্ভবত চল্লিশজনের একটা দল–ঢিবির পেছন থেকে বের হয়ে এসে লাহোরের অভিমুখে দ্রুত গতিতে ফিরে যাচ্ছে। তারা নিশ্চিতভাবেই সবচেয়ে দূরবর্তী পাহারাচৌকি এবং তারা যদি অনুরোধ করেও থাকে তাদের সাহায্যার্থে অতিরিক্ত সৈন্য প্রেরণ করা হয় নি।