বাবরের পিতা মৃত্যুর অনেককাল আগেই নিজের সমাধিসৌধের পরিকল্পনা করেছিলেন। বাবর যখন তার বিশাল-স্তনের দাইয়ের কোলে নিতান্ত দুগ্ধপোষ্য শিশু, সুলতান তখন ফারগানা আর ফারগানার বাইরে থেকে রাজমিস্ত্রী এবং অন্যান্য কারিগরদের ডেকে আনেন। তার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধায়নে আকশি দূর্গের দেড় মাইল পশ্চিমে জাক্সারটেস নদীর তীরে কারিগরের দল সমরকন্দে মহান তৈমূরের শেষ বিশ্রামস্থলের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ নির্মাণ করে। এখন ডিম্বাকৃতি গম্বুজের নীলাভ সবুজ টালির সাথে উজ্জ্বল বর্ণের রূপালি নীল টালির বিন্যাস জুন মাসের তীব্র সূর্যালোকে চোখ ধাধিয়ে দেয়। বাবর ভাবে, বাবা এসব দেখলে গর্ববোধ করতো এবং ভাবনাটা তার উত্তেজিত মুখমণ্ডলে আবছা একটা হাসির অভিব্যক্তির জন্ম দেয়।
তার চোখের দৃশ্যপট থেকে শবাধারটা আড়াল হতেই, উপস্থিত জনগণের মাঝে বিলাপের ক্রন্দন ধ্বনি গমগম করে উঠে- যাদের ভেতরে রেশমের আলখাল্লা পরিহিত গোত্রপতি আর অভিজাতদের সাথে একই কাতারে দাঁড়িয়ে রয়েছে মামুলি পশুপালকও, যাদের গায়ে তাদের পালিত পশুর গন্ধ। পার্থিব জীবনের পরিস্থিতি যাই হোক, সব মানুষই তাদের পরণের আলখাল্লা টেনে ছিঁড়ে এবং মাথার পাগড়িতে কবরের মাটি ছিটায় যার রেওয়াজ চেঙ্গিস খানের অনেক আগে থেকে চলে আসছে। তাদের মনে তখন কি ভাবনা খেলা করছিলো? এখানে কতজন তারমতো শোকগ্রস্ত? বাবর ভাবে। এসান দৌলতের চিঠির কারণে গোত্রপতিরা আজ এখানে উপস্থিত হয়েছে বটে, কিন্তু সময় যখন হবে সে তাদের কতজনের উপরে নির্ভর করতে পারবে?
“যাদের কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই এমন লোকদের থেকে সাবধান ব্যাপারটা অস্বাভাবিক, তার বাবা সবসময়ে তাকে এই উপদেশটা দিয়েছে। বাবর একবার ওয়াজির খানের দিকে আড়চোখে না তাকিয়ে পারে না, কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেই লজ্জিত হয়। বাবা মারা যাবার পরে, আর নানীজান ছাড়া, লম্বা ঋজু-পৃষ্টদেশের এই সৈনিককেই পৃথিবীতে সে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক বলে জেনে এসেছে। কিন্তু ওখানে মুখে গুটিবসন্তের দাগভর্তি ধূসর দাড়িঅলা গোত্রপতি, পাহাড়ের সুরক্ষিত আশ্রয় থেকে রাতের আঁধারে বেরিয়ে এতো দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে এসেছে যে তার গায়ের আলখাল্লা নিজের আর ঘোড়ার ঘামে মাখামাখি অবস্থা, তার কি মনোভাব? অথবা ঐ গাজরের মতো উঁচু-দাঁতঅলা, মোঙ্গলদের প্রাচীন রীতি অনুসারে যার মাথা পুরোটা কামান, যাকে তার মরহুম পিতা ষড়যন্ত্র, কপটতা আর লোভের কারণে একবার নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন এবং সম্প্রতিই ফিরে আসবার। অনুমতি দিয়েছিলেন, সে কি ভাবছে? এসান দৌলতকে আমন্ত্রণপত্র পাঠাবার সময়ে এসব ঝুঁকি নিতে হয়েছে। আশা করেছে যে কেবল মিত্রদেরই সে ডেকে পাঠিয়েছে, কিন্তু বাবর তার অল্প বয়সে একটা বিষয় খুব ভালো করেই জানে, এদের ভিতরে অনেকেই অনায়াসে পিঠ দেখাতে পারে।
কিন্তু এখন সেসবের সময় না। তার প্রথম কাজ এখন আব্বাজানকে সমাধিস্থ করা। ওয়াজির খান মাথা নত করে বাবরের ঘোড়ার অলঙ্কারখচিত মাথার সাজ শক্ত করে ধরতে সে ঘোড়া থেকে নামে। চোখের কোণের অশ্রু মুছে সে গভীর একটা শ্বাস নেয় এবং তার বাবার প্রিয় মোল্লা আর শোকার্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সমাধিগর্ভে শেষ শ্রদ্ধা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়। এক মুহূর্তের জন্য সে তার মায়ের কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করতে লালায়িত হয়ে। উঠে। কিন্তু খুতলাঘ নিগার, তার বোন আর নানীজানের সাথে শাহী হারেমে অপেক্ষা করছেন, যা বিধিসম্মত। এসব অনুষ্ঠানে মেয়েদের উপস্থিত থাকবার রেওয়াজ নেই। সুলতানের মৃতদেহ নিয়ে অনুগমনকারী অনুচরবর্গ দূর্গ থেকে বের হয়ে চপল ছন্দে বহমান জাক্সারটাসের তীরের দিকে রওয়ানা হবার সময়ে তারা দেয়াল থেকে ঝুলতে থাকা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে নিরবে শেষ বিদায় জানিয়েছেন। সমাধিসৌধের অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রবেশপথের দিকে বাবর এগিয়ে যেতে সে দেখে যে, কামবার আলী তার আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছে, প্রথমে প্রবেশ করার বাসনায়। পরণের খয়েরী আলখাল্লা তার দেহের চারপাশে নিশানের মত উড়ছে। “উজির!” বাবরের কিশোর কণ্ঠ কঠোর শোনায়। মানানসই একটা কণ্ঠস্বর। থমকে থেমে পাশে সরে দাঁড়াবার সময়ে কামবার আলীর মুখে বিরক্তির সামান্য রেশ ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়।
“আমার বাবার শবানুযাত্রীদের নেতৃত্ব আমি দেব। সেটাই বাঞ্ছনীয়।” বাবর তাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাবার সময়ে উজিরের পায়ের নরম চামড়ার নাগরা ভালো করে মাড়িয়ে দেয়। বেশ তৃপ্তিকর একটা অনুভূতি।
“অবশ্যই, শাহজাদা।”
বাবর যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শনপূর্বক মোল্লাকে তার সাথে আসতে বলে। কামবার আলী দীর্ঘ অন্ধকার গলিপথে তাদের অনুসরণ করে। রাজদরবারের অন্য সদস্যরা, তাদের পদমর্যাদা অনুসারে বাবরের অনুবর্তী হয়। ইউসুফ, রাজকোষের কোষাধ্যক্ষ হবার। কারণে, মরহুম সুলতানের শবাধারের পাদদেশে রাখার জন্য একটা পাত্রে চকচক করতে থাকা সোনার আশরফি বহন করে আনে। বাবা কাশক, শাহী বাজারসরকার হিসাবে দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে লাল চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা একটা খেরোখাতা বয়ে নিয়ে আসে। যেখানে মরহুম সুলতানের জীবদ্দশায় কৃত সমস্ত শাহী খরচের হিসাব লিপিবদ্ধ রয়েছে। খেরো খাতাটাও তার শবাধারে দেয়া হবে, যার মানে। সুলতান পরলোকে গমন করেছেন তার সমস্ত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন শেষ করে। বাকি বেগের হাতে শাহী জ্যোতিষবিদ হিসাবে একটা স্ফটিকের গোলক দেখা যায়। সে মনে মনে ভাবে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হবার পরে, এই চকচকে গোলকের। গভীরতায় দৃষ্টিপাত করে, বিষাদ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে সে ঘোষণা করবে যে, একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক বালককে সুলতান হিসাবে বরণ করে নিতে তারকারাজির সম্মতি নেই। অমাত্যগণ ভূগর্ভস্থ সমাধিকক্ষের সাতসেঁতে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালে অন্যেরা ঢালু গলিপথে ঠাসাঠাসি করে। অভ্যন্তরের ভারী বাতাসে মানুষের ঘামের গন্ধ ভুরভুর করে। ভীড়ের চাপে বাবরের দু’হাত নাড়াবার জায়গা থাকে না। মোল্লা মৃদুকণ্ঠে মোনাজাত শুরু করে। কিন্তু শীঘ্রই তার কণ্ঠস্বর তীব্রতা লাভ করে সমাধিকক্ষের অভ্যন্তরে ভাসতে থাকলে ভয়ের একটা শীতল স্রোত বাবরের মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যায়। সে একটা বদ্ধস্থানে অবস্থান করছে। কোনো শত্রু যদি এখন হামলা করতে মনস্থ করে? সে তার মানসপটে নিজের দ্বিখণ্ডিত গলা থেকে রক্ত ছিটকে জেড পাথরের শবাধারের নার্গিস আর টিউলিপের জটিল অলঙ্করণে পড়তে দেখে। সে নিজেকে প্রাণপণে চিৎকার করতে শোনে, কিন্তু গলগল করে বের হতে থাকা রক্তে শ্বাসরুদ্ধ একটা ঘড়ঘড় শব্দ ভেসে আসে।