“এটা অসম্ভব। সনাতন মর্যাদার স্মারক তৈমূর বংশের শাহজাদাদের অলঙ্ঘনীয় নিরাপত্তা দিয়েছে…” খুতলাঘ নিগারের কণ্ঠস্বর হোঁচট খায়।
“আমাদের এখন কি করণীয়?” এসান দৌলত ওয়াজির খানের বাহু আঁকড়ে ধরে জিজ্ঞেস করে। হাড়সর্বস্ব অবয়ব সত্ত্বেও তার ভিতরে একটা যুদ্ধংদেহী শক্তি লুক্কায়িত রয়েছে। এসান দৌলত ধমনীতে চেঙ্গিস খানের রক্ত আর চেতনায় তার আত্মাকে ধারণ করেন।
“হ্যাঁ, এখন আমাদের কি করণীয়?” বাবর অন্ধকার ছেড়ে বের হয়ে এসে জানতে চায়। দেয়ালের কুলঙ্গিতে রক্ষিত প্রদীপের নিভুনিভু আলোয় তার মুখের স্থির সংকল্প আর সিদ্ধান্ত প্রতিফলিত হয়।
“আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে। আমাদের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” ওয়াজির খান সংক্ষেপে কেবল এটুকুই বলে। “আগামীকাল আপনার আব্বাজান আমাদের মরহুম সুলতানের নামাজে জানাজার ঠিক অব্যবহিত পরেই দূর্গের শাহী মসজিদে আমরা আপনাকে সুলতান হিসাবে ঘোষণা করবো। মোল্লা একবার আপনার নামে খুবা পাঠ করার পরে কেউ যদি আপনার বিরোধিতা করে তবে সে চক্রান্তকারী হিসাবে চিহ্নিত হবে। আর আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আমাদের শুভাকাক্ষিরা যেন এ সময় প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে উপস্থিত থাকে। আমার প্রহরীরা সবাই বিশ্বস্ত। ফারগানার অনেক অভিজাত ব্যক্তিও আমাদের পক্ষে রয়েছেন। বিশেষ করে আপনি যদি তাদের বিশ্বস্ততার প্রতিদান দেবার প্রতিশ্রুতি দেন।”
“আমাকে কাগজ, দোয়াতদানি আর পালক এনে দাও,” এসান দৌলত তার নাতিনকে আদেশ করে। “আজ রাতটা আমরা কেবল শোক পালনে কাটাবো না, আমাদের নিরুদ্বেগ আরও বড় বিপর্যয় আমাদের উপরে আপতিত করবে। আমি খুব ভালো করেই জানি কাদের উপরে আমরা বিশ্বাস রাখতে পারি আর কারা কপট, অবিশ্বাসী। সবাই মনে করে আমি কিছুই বুঝতে পারি না, কিন্তু চারপাশে কি ঘটছে আমি খুব ভালোই লক্ষ্য করি। এইসব গুরুত্বপূর্ণ চিঠি লেখার দায়িত্ব আমি কোনো খুশনবিশকে দিতে চাই না, চিঠিগুলো আমি নিজে লিখবো। ওয়াজির খান তোমার উপরে প্রতিটা চিঠি নিরাপদে আপন আপন গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব রইল। চিঠিগুলো কেন পাঠান হচ্ছে জিজ্ঞেস করবার ধৃষ্টতা কেউ দেখালে তাকে বলবে মরহুম সুলতানের জানাজা উত্তর ভোজের আমন্ত্রণপত্র। কথাটা আংশিক সত্যি কিন্তু সেগুলো একই সাথে মসজিদে বাবরের অভিষেকের আমন্ত্রণপত্রও বটে। আকশীর আশেপাশে ঘোড়ায় অর্ধদিনের দূরত্বে বসবাসকারী সব বিশ্বস্ত গোত্রপতিকে আমি ডেকে পাঠাচ্ছি। আমি তাদের অনুরোধ করবো জানাজা শেষে ভোজসভা আরম্ভ হবার পরে গোপনে আর নিঃশব্দে তারা যেন মসজিদে প্রবেশ করে। বাবর বেটা, আমার পাশে এসে তেলের প্রদীপটা একটু উঁচু করে ধরো।”
রাত গভীর হবার সাথে সাথে তাদের চারপাশে দূৰ্গটা নিরব হয়ে আসে। বাবর অপলক তাকিয়ে দেখে নানীজান অক্লান্তভাবে লিখে চলেছেন। মাঝে মাঝে কেবল পালকের মাথা তীক্ষ্ণ করতে বা কালি শেষ হয়ে গেলে লেখায় সাময়িক বিরতি দেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার, সে ভাবে, রক্তের বৈরীতা আর তিক্ত শত্রুতার কথাই নানীজান কেবল জানে না, চেঙ্গিস খানের সময় থেকে গোত্রসমূহের ভিতরে চলে আসা জটিল বৈবাহিক সম্পর্ক আর ব্যক্তিগত বিশ্বস্ততার গভীর সম্পর্কের বিষয়েও তার অসীম জ্ঞান। এই প্রথম সে তার প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করে তাকে জোর করে গোত্রপতিদের ভিতরে কারা বন্ধু আর কে কে শত্রু সে বিষয়ে নানীজান তাকে ধৈর্য ধরে শিখিয়েছেন বলে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- এর পেছনের কারণগুলো সম্পর্কেও তিনি তাকে বলেছেন। তার মুখের সূক্ষ্ম ভাঙাচোরা দাগের দিকে তাকিয়ে বাবর স্বস্তি বোধ করে যে এসান দৌলত তার মিত্র, শত্রু নন।
সবগুলো চিঠি লেখা শেষ হতে- কাগজের উপরে তুর্কী লিপির এলোমেলো বিন্যাস সেগুলো ভাজ করে লাল মোম দিয়ে সীল করে একজন বিশ্বস্ত লোক দিয়ে চিঠিগুলো পৌঁছে দেবার জন্য ওয়াজির খানকে দেয়া হয়। বাইরের প্রাঙ্গণে দূর্গ থেকে বের হয়ে যাওয়া ঘোড়ার খুরের শব্দ প্রতিধ্বনি তোলে। সুবেহসাদিকের সময়ে ফজরের নামাজের আজানের ধ্বনি ভেসে আসবার পরেই কেবল এসান দৌলত তার লেখনী বন্ধ করেন।
১.২ প্রথম রক্তপাত
০২. প্রথম রক্তপাত
বাবর ঘোড়ার পিঠে বসে, ওয়াজির খানের মনোনীত আটজন প্রহরীকে কাঁধে করে ধূসর-সবুজ জেড পাথরের শবাধারে তার বাবার মরদেহ বয়ে নিয়ে আসতে দেখে। ভারী পাথরের কাঠিন্যের জন্য তাদের প্রত্যেকের কাঁধে ভেড়ার চামড়ার পুরু আস্তর দেয়া থাকলেও শবাধারটা অসম্ভব ভারী। তাদের বাতাসে পুড়ে তামাটে বর্ণ ধারণ করা মুখ ঘামে ভিজে আছে এবং একজন হোঁচট খেয়ে আরেকটু হলেই কাঁধ থেকে শবাধারটা ফেলে দিতো। উপস্থিত সবাই আঁতকে উঠে জোরে শ্বাস টানে শবাধারটা যদি মাটিতে আছড়ে পড়ে তবে সেটা একটা অশনিসঙ্কেত হিসাবে বিবেচিত হবে। বাবরের পাকস্থলীর কাছটা টানটান হয়ে যায় কিন্তু কামবার আলীর কচ্ছপের মতো মুখ নির্বিকার থাকে।
“হুঁশিয়ার, তোমরা আমাদের সুলতানকে বহন করছে।” ওয়াজির খানের কণ্ঠস্বরের তীব্রতায় প্রহরীটা নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় কাঁধে শবাধারের ভার নেয় এবং শবাধারবাহীরা স্মৃতিসৌধের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সমাধিকক্ষের দিকে ঢালু দরদালান বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে।