বাবর তার নানীজানের মুখের দিকে তাকাতে, কে ছিলেন মহান যোদ্ধা- চেঙ্গিস খান নাকি তৈমূর, সেটা নিয়ে বাবার সাথে নানীজানের নিরন্তর তর্কের কথা তার মনে পড়ে যায়। জন্মের সময় বাবরের মাথা বড় থাকায়, আম্মিজানের যন্ত্রণাদায়ক দীর্ঘস্থায়ী গর্ভাবস্থার কথা এসান দৌলত সবসময়ে গল্প করেন। পুরোটা সময় তিনি তার মেয়েকে আশ্বাস বাণী শুনিয়েছিলেন যে, চেঙ্গিসের মতই বাবরও তার ক্ষুদ্র হাতের মুঠোয় রক্তের দলা নিয়ে তার যোদ্ধা নিয়তির প্রতীক- জন্ম নেবে। কিন্তু তার ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হয়। অবশ্য এতে বিন্দুমাত্র হতাশ না হয়ে তিনি বলতে থাকেন, “সে নিশ্চয়ই একজন মহান শাসক হবে!”
এসান দৌলত যেনো তার চোখের দৃষ্টি অনুভব করে। তিনি বাবরের দিকে তাকালে সে নানীজানের চোখে এমন কিছু একটা দেখে যা আগে কখনও দেখেনিঃ অনিশ্চয়তা। তিনি এবার বীণাটা নামিয়ে রাখেন। “খানজাদা, কাউকে বলো বরফ দিয়ে শরবত দিতে,” তিনি তার মোল বছরের নাতির দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলেন।
বাবর দেখে তার লম্বা অপূর্ব সুন্দরী বোন দ্রুত উঠে দাঁড়ায়, পরিচারিকাকে আদেশ দেয়। সে কামরার প্রবেশপথের কাছে পৌঁছাতে যেখানে প্রদীপের আলোর আগ্রাসন সবচেয়ে ক্ষীণ, সে আরেকটু হলেই হারেমের প্রধান পরিচারিকা ফাতিমার সাথে ধাক্কা খেত। বেচারীর চওড়া, ভোতা মুখ অশ্রুসিক্ত। “মালিক,” খানজাদা বরফ দেয়া শরবতের কথা বলার আগে সেই বলতে শুরু করে, “মালিক, ওয়াজির খান আপনার মহামহিম আম্মিজান আর নানীজানের সাথে দর্শন প্রার্থনা করেছে।”
“আগামীকাল সকাল পর্যন্ত সে অপেক্ষা করতে পারবে না? তারা শোকাবিভূত এবং তাদের বিশ্রামের প্রয়োজন।
“সে বলেছে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ।” ফাতিমা হাত দিয়ে অনুনয়ের ভঙ্গি করে যেন তার হয়ে মিনতি করছে।
খানজাদা তার আম্মিজান আর নানীজানের দিকে তাকিয়ে তাদের ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করতে দেখে। তারপরে খুতলাঘ নিগার বলেন, “আমরা তার সাথে দেখা করবো। বাবর, তুমি অনুগ্রহ করে এখন যেতে পার।”
“কিন্তু কেননা? আমি থাকতে চাই।”
“আমি যা বলছি তাই করো।” তার আম্মা এবার উঠে বসেন।
“না।” এসান দৌলত এবার হস্তক্ষেপ করেন, “সে ফারগানার নতুন সুলতান। ওয়াজির খান যা বলতে এসেছে তা আমাদের চেয়ে বেশি তাকে প্রভাবিত করবে। তাকে থাকতে দাও।”
খুতলাঘ নিগার তার কিশোর ছেলের স্থিরসংকল্প কচি মুখের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মনুস্থির দিকে তাকায় এবং মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। তিন রমণী নিজেদের সামলে নিয়ে তাদের মুখের নেকাব টেনে দেয়। বয়োজ্যেষ্ঠ রমণী তার একপাশে মেয়ে অন্যপাশে নাতিনকে নিয়ে দাঁড়াতে, বাবর তাদের কাছ থেকে দূরে সরে আসে। নানিজানের কথায় তার ভিতরে কিছু একটা বদলে গিয়েছে। সে আশঙ্কিত কিন্তু সেইসাথে উত্তেজিতও বটে।
ওয়াজির খান নিচু সরদলের নিচে দিয়ে ঝুঁকে ভেতরে প্রবেশ করে গভীর শ্রদ্ধায় নিজেকে তাদের সামনে প্রণত করে। “এত রাতে অনাহূত সাক্ষাৎ প্রার্থনার জন্য আমাকে মার্জনা করবেন, মালিক।”
“কি হয়েছে?” নেকাবের উপর দিয়ে এসান দৌলত বিচক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে তার মুখ খুটিয়ে দেখে।
“বিষয়টা আমাদের মহামান্য সুলতানকে নিয়ে।” ওয়াজির পলকের জন্য আঁধারে দাঁড়িয়ে থাকা বাবরের দিকে তাকায়। তিনি এখানে একটুও নিরাপদ নন। আমরা এখন এখানে যখন আলাপ করছি, কুচক্রীর দল তখন তার কাছ থেকে মসনদ কেড়ে নিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের ষড়যন্ত্র করছে।”
“তোমাকে আরও খুলে বলতে হবে। কে ষড়যন্ত্র করছে?” এসান দৌলত জানতে চান। তার চোখের রঙ বদলে গেছে এবং চোখের নিচের উঁচু হাড়ে লাল রঙের ছোপ দেখা যায়।
“আমরা তোমাকে বিশ্বাস করি।” খুতলাঘ নিগার মৃদুকণ্ঠে বলেন। “তুমি ছিলে মরহুম সুলতানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেনাপতি। তারচেয়েও বড় কথা, আমার স্বামীকে শিশুকালে তোমার আপন মা স্তন্যদুগ্ধ দ্বারা লালন করেছেন, যা তোমাকে সুলতানের দুধ-ভাইয়ের সম্মান দান করেছে। রক্তের মত অচ্ছেদ্য একটা বন্ধনে তোমাকে আবদ্ধ করেছে। সামনের অনাগত দিনগুলোয় আমি দেখতে চাই তুমি সেই বন্ধনের সম্মান রক্ষা করো… আমার সন্তানকে তুমি ঠিক তার আব্বাজানের মতো আগলে রাখবে… দয়া করে সব খুলে বলো। তুমি কি শুনেছো?”
“অসহিষ্ণু, রাজবৈরী, কুটিল স্বভাবের লোকেরা আপনাদের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। উজির আর দরবারের অন্য সদস্যরা মসনদে অন্য আরেকজনকে অভিষিক্ত করার পরিকল্পনা আঁটছে- তারা ভেবেছে আমি তাদের কথোপকথনের শেষ অংশটুকু শুনেছি। কিন্তু তারা জানে না দরবারের বাইরে নিভৃতে দাঁড়িয়ে আমি তাদের পুরো আলোচনা শুনেছি। তারা রাজ্যের মঙ্গলের উসিলায় কাজটা হাসিল করতে চায়। আপনাদের সন্তান শাসনকার্য পরিচালনার পক্ষে নিতান্ত অল্পবয়সী এবং তাকে সিংহাসনের অধিষ্টিত করলে ফারগানায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, যদি তারা শাহজাদা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠা পর্যন্ত কোনো রাজপ্রতিভূ নিয়োগ না করে। মুশকিল হল, আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর শাসকদের কাছে অনেক আগেই তারা নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রভুর স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। রাজ্যে শীঘ্রই তাদের প্ররোচণায় অশান্তি শুরু হবে। তাদের লোভের কারণে, মসনদের জন্য প্রতিপক্ষের ভিতরে যুদ্ধ শুরু হবে। একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আরেকটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জন্ম দেবে। আর সবশেষে যেই বিজয়ী হোক, আপনার ছেলে তততদিন জীবিত থাকবে না। যতোদিন সে বেঁচে আছে- সবাই তাকে একটা হুমকি হিসাবেই দেখবে।”