কামবার আলী, মাথা নুইয়ে ভদ্রতাসূচক সম্মতি প্রকাশ করে। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয় আজ রাতেই উত্তরের পাহাড়ী পথে মোঘুলিস্তানের উদ্দেশ্যে দূত পাঠাবে নতুবা দেরি হয়ে যাবে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, তাড়াহুড়ো করলে আমরা হোঁচট খেতে পারি।” কণ্ঠস্বরে গভীর চিন্তার ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে সে বলে। “শাহজাদা বাবরের স্বার্থ যাতে বিঘ্নিত না হয় সেজন্য আমাদের ভাবনা চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হলে তিনিই হবেন সিংহাসনের যোগ্য হকদার। আর ততোদিন পর্যন্ত ফারগানাকে নিরাপদ রাখতে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের ভেতর কাউকে রাজপ্রতিভূ নিয়োগ করতে পারি।” বাবরকে এ জীবনে আর তাহলে সিংহাসনে বসতে হবে না, সে মনে মনে ভাবে। একটা ছোট দূর্ঘটনা ঘটতে আর বেশি দেরি নেই। ঘটনাটা সাধারণভাবে সাজাতে হবে যে…
দরবারে ওয়াজির খান প্রবেশ করতে তারা চারজন উঠে দাঁড়ায়। তাকে ক্লান্ত দেখায় এবং তামাটে মুখের উপরে আড়াআড়ি গোলাপী ক্ষত চিহ্নটা- এক যুগ আগে চালানো তরবারির ছোবল যা তার ডানচোখের জ্যোতি ছিনিয়ে নিয়েছিল। এখন ফুলে থাকায় মনে হয় আঘাতটা যেন সপ্তাহখানেকের পুরানো। “মুরুব্বীগণ, দেরি। হবার জন্য আমাকে মার্জনা করবেন।” সে তার ডান হাতের তালু দিয়ে নিজের বুক স্পর্শ করে এবং কামবার আলী উজির পদে আসীন থাকায় তিনি তাদের ভিতরে প্রধান সেটা প্রকাশ করতে তাকে মাথা নত করে অভিবাদন জানায়। “আমি দূর্গের চারপাশে পাহারা দ্বিগুণ করেছি কিন্তু এখন পর্যন্ত সবকিছু শান্তই আছে। সুলতানের মরদেহ গোসল দেয়া হয়েছে এবং আগামীকালের জানাজার সব ইন্তেজাম করা হয়েছে।”
“ওয়াজির খান আমরা আপনার কাছে ঋণী থাকলাম। আমি খুশি হয়েছি।”
“আপনারা ফারগানায় রাজপ্রতিভূ নিয়োগের ব্যাপারে আলাপ করছিলেন?” ওয়াজির খান কামবার আলীর পাশে বসে এবং উজিরের দিকে নিজের ভাল চোখ দিয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে সে তিক্ততা অনুভব করে।
“আমরা আলোচনা করছিলাম। রাজ্যের দায়িত্ব সামলাবার তুলনায় শাহজাদা বাবরের বয়স অল্প। আর উজবে কুকুরের দল আমাদের হুমকী দিচ্ছে।” উজবেকদের নাম উচ্চারণের সময়ে উজির থুতু ফেলার ভঙ্গি করে।
“শাহজাদার বয়স অল্প সেটা সত্যি, কিন্তু তিনি আমাদের প্রয়াত সুলতানের একমাত্র জীবিত সন্তান এবং রাজ্য পরিচালনার জন্য অল্পবয়স থেকেই তাকে প্রস্তুত করা হয়েছে। এটাই তার নিয়তি আর তার পিতা আমাদের মরহুম সুলতানের সেটাই ইচ্ছা ছিলো। বাবর সাহসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আর দ্রুত সবকিছু রপ্ত করতে পারে। আমি নিজে তার সাক্ষী। সুলতানের অনুরোধে, বিশেষ করে বাবরই তার একমাত্র উত্তরাধিকারী এ বিষয়টা নিশ্চিত হতে, আমি তাকে অসি চালনা, তীরন্দাজি, কিভাবে বর্শা ব্যবহার করতে আর রণকুঠার ছুঁড়তে হয়, এসব কিছু যথেষ্ট সময় নিয়ে শিখিয়েছি। বাবর তার বয়সের অন্য ছেলেদের তুলনায় অনেক পরিণত, বিচক্ষণ। আমি নিশ্চিত আমাদের পাঁচজনের পরামর্শ তাকে এই বৈরী সময় অতিক্রম করতে সহায়তা করবে।” ওয়াজির খান নিরাসক্ত কণ্ঠে বলে।
“বন্ধু ওয়াজির খান, বিষয়গুলো যদি এত সহজ হত।” উজির ম্লান হেসে বলে। “শান্তিপূর্ণ সময়ে তোমার পরিকল্পনা অনুসারে কাজ হত, কিন্তু উজবেকদের আকাক্ষার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। তারা যে মুহূর্তে শুনবে ফারগানার সুলতান তার অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে সিংহাসনে রেখে মারা গেছেন, তারা আমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে, পেট চিরে আমাদের নাড়িভূড়ি বের করবে আর আমাদের রমণীদের অসম্মান করবে।”
“মহামান্য উজির, আপনি কি বলেন?”
“শাহজাদা বাবর প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত আমরা মরহুম সুলতানের কোনো আত্মীয়কে মসনদ রক্ষার দায়িত্ব দিতে পারি। কিন্তু প্রশ্নটা হলো আমরা কাকে অনুরোধ করবো…”
“আমি বুঝেছি। উত্তম প্রস্তাব। আমি মামূলি একজন সৈনিক আর আজ রাতে আমার আরও কাজ আছে। রাজনৈতিক বিষয়ে আপনারা আমার চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ। আমাদের রাজ্যের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে আল্লাহতালা আপনাদের হেদায়েত করুন।” ওয়াজির খান উঠে দাঁড়ায়, মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে ধীর পায়ে দরবার ত্যাগ করে। দরবার থেকে বের হয়ে এসেই তার পায়ের গতি বৃদ্ধি পায়। মাঝের আঙ্গিনা অতিক্রম করে দূর্গের অপর প্রান্তে অবস্থিত শাহী হারেমের দিকে সে এগিয়ে যায়।
***
বাবর তার আম্মিজান, খুতলাঘ নিগারের পাশে বসে আছে। তার লম্বা কালো চুলে স্বস্তির পরশ পেতে মায়ের আঙ্গুল বিলি কাটে। বাবর ইতস্তত ভঙ্গিতে শোকসংবাদটা জানাবার পরেই তার মায়ের চেহারা এতোটাই ফ্যাকাশে হয়ে যায় যে তার ভয় হয় আম্মিজান বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাবে এবং খবরটা শোনার পরে তিনি অন্ধ মহিলার মত শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাস্তবতা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরে, সে জিকির করার মত দুলতে শুরু করে। তার ভেতর থেকে তীব্র শোকের তীক্ষ্ণ ভয়ঙ্কর পরিদেবন বিষাদের মাত্রা সঞ্চয় করে বের হয়ে আসে। সুলতানের যদিও অনেক রক্ষিতা ছিলো কিন্তু তিনিই ছিলেন তার একমাত্র স্ত্রী। তাদের ভিতরে মহব্বতের সম্পর্কটা বেশ দৃঢ় ছিলো।
সে তাকিয়ে তার নানিজান, এসান দৌলতকে, আনমনে বীণার তারে টোকা দিতে দেখে। বীণার বিষণ্ণ সুর শরণ সন্ধানী পাখির মত কামরার ভেতরে প্রতিধ্বনি তুলে ভাসতে থাকে। তার মাথার সাদা চুল, যা অল্প বয়সে বেশ ঘন ছিলো কিংবা সেরকমই তিনি দাবি করেন, কাঁধের উপরে বেণী করা। তার কিশমিশের ন্যায় চোখ লালচে হয়ে আছে কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে নিয়েছেন। বাবরকে একটু আগেই তিনি কান্না চেপে স্থিরসংকল্প কণ্ঠে বলেছেন, তিনি একজন খানিম, চেঙ্গিস খান, মানুষ যাকে মহাসাগরসম শাসক বলতো, তৈমূরের জন্মের দু’শো বছর আগে চেনা পৃথিবীর অর্ধেকটা যিনি অভিহরণ করেছিলেন, তার সাক্ষাৎ বংশধর।