***
উত্তেজিত হওয়া সত্ত্বেও কামবার আলি স্পষ্ট টের পান তার অল্প বয়সী সুন্দরী স্ত্রী ফরিদা আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি যন্ত্রবৎ সহবাসের দাম্পত্য দায়িত্ব পালন করছে। নানা কারণে প্রধান উজিরের মন আজ বিক্ষিপ্ত অশান্ত হয়ে রয়েছে। সুলতানের আকস্মিক অসাধারণ শাহাদাতবরণ তাকে গভীর চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। আর এ থেকে লাভবান হতে চাইলে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য তার হাতে সময় খুবই কম। বারো বছরের এক বালক সুলতান হবে? হতে পারে… কিন্তু আবার না হলেই বা কি ক্ষতি। কুঁচকিতে দ্রুত পানির ছিটে দিয়ে সে জরির কাজ করা ঘন নীল রঙের আলখাল্লা গায়ে কোনোমতে জড়িয়ে নিয়ে পেছনে একবারও না তাকিয়ে ফরিদার কামরা থেকে বের হয়ে যায়।
দপদপ করে জ্বলতে থাকা তেলের প্রদীপে আলোকিত দূর্গের আভ্যন্তরীণ গলিপথের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে শাহী হারেম থেকে ভেসে আসা বিলাপের ধ্বনি সে শুনতে পায়। বাবরের মা আর নানিজান, আঁদরেল দুই মহিলা, তাদের যুগল কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে সামান্য যেটুকু সংশয় অবশিষ্ট ছিল সেটাও দূর হয়। আনুষ্ঠানিক শোকপ্রকাশ তাহলে শুরু হয়েছে। এই দুজনের ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে। তারা শোকে এতটা দিশেহারা হবে না যে, বাবরের স্বার্থ কিংবা নিরাপত্তার বিষয়ে তাদের কোনো খেয়াল থাকবে না।
প্রধান উজির রাজকীয় দরবারের দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে সে অন্যান্য রাজকীয় অমাত্যদের ডেকে পাঠিয়েছে। দরবারের সবুজ চামড়ার উপরে পিতলের গজাল আটকানো দরজা দু’জন প্রহরী ভেতরে প্রবেশের জন্য খুলে ধরতে, সে দেখে তিনজন রাজ-কর্মচারি ইতিমধ্যে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে: ইউসুফ, রাজকীয় কোষাগারের নির্ভীক কোষাধ্যক্ষ, কোষাগারের সোনালী চাবি একটা লম্বা চেনের সাহায্যে তার চওড়া গলায় ঝুলছে; বাকি বেগ, রাজ-জ্যোতিষী, যার রুগ্ন অস্থির আঙ্গুল তসবী জপছে; এবং লোমশ ভ্রর পাকানো তারের মত শরীরের বাবা কাশক রাজকীয় বাজার সরকার। ওয়াজির খান কেবল অনুপস্থিত।
শূন্য সিংহাসনের নিচে সুন্দর নকশা করা পুরু লাল গালিচার উপরে অসম দর্শন তিনজন আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে অপেক্ষা করছে। অধিকার শূন্য বিধায় সিংহাসনটাকে ছোট, গুরুত্বহীন আর মলিন দেখায়, সোনার গিল্টিতে হাল্কা দাগ পড়েছে। আর লাল মখমলের সোনার টাসেলযুক্ত কুশনে সময় আর ব্যবহারের ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়।
“বেশ,” কামবার আলী উপস্থিত লোকদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “এমন ঘটতে পারে কে আর আগে থেকে ভেবেছিলো?” আরো কিছু বলবার আগে সে চুপ করে তাকিয়ে থেকে তাদের চোখের ভাষা পড়তে চেষ্টা করে।
“আল্লাহতা’লার মর্জি বোঝা ভার।” বাকি বেগ নিরবতা ভেঙে বলে উঠে।
“কি পরিতাপের কথা তুমি নিয়তির গর্ভে কি লুকিয়ে আছে দেখতে পাওনি। অন্তত একবারের জন্য হলেও তারকারাজি তাদের রহস্য তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছে।” বাবা কাশক বলেন।
রাজজ্যোতিষী বাজার সরকারের বিদ্বেষপূর্ণ বাক্যবাণে ক্ষিপ্ত হয়ে ক্রুদ্ধ চোখে তার দিকে তাকায়। “ঈশ্বর চান না যে মানুষ সবসময়ে তার নিয়তির কথা জানতে পারুক- বিশেষ করে একজন সুলতান, যে তার প্রজাদের কাছে ঈশ্বরের মতোই প্রতাপশালী আর তার মতই তাদের দণ্ডমুণ্ডের হর্তাকর্তা।”
“আমি তোমাকে ক্ষিপ্ত করতে চাইনি, কিন্তু সুলতান যদি নিজের মৃত্যুর কথা আগে জানতে পারতেন, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি বারো বছরের বালককে তার উত্তরাধিকারী হিসাবে মনোনীত করতেন না,” বাবা কাশক মুদুস্বরে কথাটা বলে আক্ষেপের সাথে মাথা নাড়ে।
কামবার আলীর নাড়ীর স্পন্দন সহসা বেগবান হয়ে উঠে। “বটেই তো। রাজ্য আর রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে শক্তিশালী, পরিণত নেতার প্রয়োজন। সুলতানের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেলে সাইবানী খান আর তার মোঙ্গল বর্ণসংকরের দল আমাদের সীমান্তের কাছে এসে হাঁকডাক শুরু করবে। তৈমূরের বংশের সুলতানদের চোখ উপড়ানো কাটা মুণ্ড দিয়ে সে একটা মিনার তৈরি করবে বলে শপথ নিয়েছে। একটা পুঁচকে ছোকরা তার কবল থেকে ফারগানাকে বেশি দিন স্বাধীন রাখতে পারবে না।”
সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়, সবার মুখে বিষণ্ণতার মুখোশ আঁটা। যেনো ফারগানার কল্যাণই তাদের একমাত্র বিবেচ্য বিষয়।
“উজবেকরাই কেবল আমাদের একমাত্র ভয়ের কারণ না। আমাদের মরহুম সুলতান তার নিজের পরিবারেই অনেক শত্রুর জন্ম দিয়েছেন- সমরকন্দের সুলতান, তার জ্ঞাতী ভাইয়ের রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল দখলে তার অভিযানের কথা নিশ্চয়ই তিনি এখনও ভুলে যাননি।”
“অবশ্যই সমরকন্দের সুলতান নিজে একজন শক্তিমান যোদ্ধা।” কামবার আলী মৃদু কণ্ঠে মনে করিয়ে দেয়। “মোঘুলিস্তানের খানও কম শক্তিশালী না।” শেষবার ফারগানা সফরে এসে খান স্বর্ণমুদ্রায় ঠাসা বেগুনী মখমলের একটা থলে তার লোভী হাতে গুঁজে দিয়েছিল, সেই স্মৃতি মুহূর্তের জন্য উজিরের মনে ভেসে উঠে। খানের কথা তার মনে আছে: “ফারগানায় যদি কখনও আমার প্রয়োজন অনুভূত হয়, আমাকে কেবল সংবাদ পাঠাবে এবং ঝড়ের বেগে আমি উপস্থিত হব।” সিংহাসন উপহার হিসাবে পেলে খান তাকে নিশ্চয়ই আরো উদারভাবে পুরস্কৃত করবে।
“আরো আছে কাবুলের শাসনকর্তা তিনিও তৈমূরের বংশধর, আমাদের প্রয়াত সুলতানের জ্ঞাতী ভাই।” বাবা কাশক এবার সরাসরি উজিরের চোখের দিকে তাকায়। “তিনি নিশ্চয়ই ফারগানাকে রক্ষা করবেন…”।