ভারী কণ্ঠস্বরটা তার পরিচিত। তার বাবার দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান ওয়াজির খানের কণ্ঠ। “কি বলতে চান আপনি…?” কথা বলতে তার রীতিমত কষ্ট হয়: মুখের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ আর কেমন কাঁকড়ময় একটা অনুভূতি এবং জিহ্বার আকৃতি যেনো সহসা মুখের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তার কথা কেমন জড়ান আর দুর্বোধ্য শোনায় এবং সে আবার বলতে চেষ্টা করে। “কি হয়েছিলো…?” অনেক কষ্টে সে বলে। “ভূমিকম্প ছিল না, তাই না?”
প্রশ্নটা করে বাবর নিজেই অনেক কষ্টে তার পানিপূর্ণ চোখের পাতা খুলে এবং উত্তরটা নিজের চোখেই দেখতে পায়। ছাদের যেখানে পায়রার চবুতরা ছিল সেখানের একটা বিশাল অংশ বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে, যেনো কোনো অতিকায় হাত পিঠার একটা কোণা ভেঙে নিয়েছে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে শুষ্ক আর ফাটল ধরা অংশটা আর ভার বহন করতে পারেনি। কবুতরের দল বাতাসে তুষারকণার মত উড়াউড়ি করছে।
দীর্ঘকায় সৈনিকের নিরাপদ বাহুর বেষ্টনী থেকে মোচড় খেয়ে মুক্ত হয়ে বাবর সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বাবাকে আর দেখতে পাবে না এই অনুভূতিটা সহসা তার পেটের ভেতরে একটা বিশাল শূন্যতার জন্ম দেয়। সুলতানের ভাগ্যে কি ঘটেছে? “সুলতান, অনুগ্রহ করে পিছনে সরে আসেন।”
বাবর ধবংসস্তূপে পরিণত হওয়া ছাদের টিকে থাকা অংশের উপর দিয়ে সন্তপণে এগিয়ে গিয়ে নিচের গিরিখাতের দিকে উঁকি দিতে তার কপালে শীতল ঘামের সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসা ধূলোর কুয়াশার ভিতর দিয়ে সে কবুতরের চবুতরা আর দেয়ালের ভেঙে পড়া অংশটুকু নিচের পাথুরে ভূমিতে শতধাবিভক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে দেখতে পায়। সেখানে তার বাবার কোনো চিহ্ন সে খুঁজে পায় না। তারপরে বাবর পাথরের ফাটলে জন্ম নেয়া একটা ঝোঁপের ডালে তার বাবার লালচে-খয়েরী রঙের পাগড়িটা কাত হয়ে ঝুলে থাকতে দেখে। চবুতরার সাথে সে নিশ্চয়ই নিচে আছড়ে পড়েছে। ভেতর থেকে উঠে আসা ভয়ের একটা কাঁপুনি দমন করে বাবর ভাবে, সুলতান ধ্বংসস্তূপের নিচে আহত অবস্থায় চাপা পড়েছেন এবং সম্ভবত মৃত।
সে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এমন সময় দূর্গের পাদদেশে অবস্থিত তোরণ থেকে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে সৈনিকেরা বেরিয়ে এসে পাথরের উপর দিয়ে দ্রুত গিরিখাদের ভেতরে নামতে শুরু করে।
“অপদার্থের দল, জলদি করো!” ওয়াজির খান বাবরের পাশে এসে তাকে পুনরায় নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে সৈনিকদের লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে ওঠে। তারা দুজনে নিরবে সন্ধ্যার ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে সৈনিকদের মশালের কমলা আভায় তাদের ধবংসস্তূপ সরিয়ে খুঁজতে দেখে। একজন একটা মৃত কবুতর খুঁজে পায় এবং ক্ষুদ্র নিথর দেহটা অপাংক্তেয়ভাবে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে। কোথা থেকে একটা বাজপাখি এসে- ছো মেরে মৃত কবুতরটা নিয়ে আবার আকাশে উড়ে যায়।
“আব্বাজান…” বাবর তার দেহের কাঁপুনি কিছুতেই থামাতে পারে না। নিচের গিরিখাদে উদ্ধারকারী দল পাথর আর মাটির একটা বড় চাই সরাতে সে তার নিচে কাপড়ের টুকরোর মত কিছু একটা দেখতে পায়। বাবার আলখাল্লার অংশ। কিছুক্ষণ আগেই সেটার রঙ ছিল ধুসর আকাশী। এখন রক্তে ভিজে সেটা লাল আর নীলের মিশ্রণে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। আরও কিছু অধীর মুহূর্ত অতিক্রান্ত হয়। সৈনিকেরা তার বাবার দেহ ধবংসস্তূপের নীচ থেকে বের করে নিয়ে আসে। উপর থেকে বাবরের কাছে সেটা কবুতরের নিথর দেহের মত দোমড়ানো প্রাণহীন মনে হয়। সৈনিকেরা এবার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা সেনাপতির দিকে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নির্দেশের জন্য তাকায়।
ওয়াজির খান ইশারায় সুলতানের দেহটা তাদের দূর্গের অভ্যন্তরে নিয়ে আসতে বলে। আদেশটা দিয়ে সে বাবরকে আরও ভেতরের দিকে নিয়ে এসে আলতো করে তার দৃষ্টি ধ্বংসযজ্ঞের দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে। তার চোখে-মুখে এখন কঠোর অভিব্যক্তি, সেই সাথে বাবরের দিকে তাকাতে সেখানে বুঝি চিন্তার ঝিলিক দেখা যায়। তারপরে সে হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে সেজদার ভঙ্গিতে কপাল মাটিতে ঠেকায়। “মির্জা বাবর ফারগানার নতুন সুলতানের জয় হোক। আপনার পিতার রুহ্ পাখির মত উড়ে যেন বেহেশতের দ্বার অতিক্রম করে।”
বাবর একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন সে এইমাত্র যা বলেছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করে। তার পিতা- কিছুক্ষণ আগেও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একটা মানুষ- ফারগানার সুলতান, এখন মৃত। সে আর কখনও তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে না, বা মাথায় তার ভারী হাতের উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করবে না, বা ভালুকের প্রবলতায় বাবা আর কখনও তাকে আলিঙ্গন করবে না। ফারগানার উপত্যকায় শিকারের অভিযানে সে আর কখনও তার সঙ্গী হবে না। তাঁবুর আগুনের সামনে তার পাশে গুটিসুটি হয়ে বসে রাতের বাতাসে সৈন্যদের গানের গুনগুন শব্দ মিশে যেতে শুনবে না। বাবর নিরবে কাঁদতে শুরু করে। তারপরে পেটের গভীর থেকে উঠে আসা তীক্ষ্ণ বিলাপে তার কিশোর দেহ কেঁপে কেঁপে উঠে।
কান্নার ভিতরেই সন্দেহ আর অনিশ্চয়তা, সেই সাথে তীব্র শোক তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এখন সে সুলতান… তার বংশগৌরব, মৃত্যুর আগ মুহূর্তে বাবার বলে যাওয়া আশা কি সে পূরণ করতে পারবে? কোনো অব্যক্ত কারণে তার বাবার মুখাবয়বের বদলে সেখানে কৃশ আরো বৃদ্ধ একজনের মুখ, যার চোখের নিম্নাংশের হাড় বেশ বেঁকে নেমে এসেছে এবং শীতল আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চোখে “দীপ্তিহীন মোমের আলো”র মত দৃষ্টি ভেসে উঠে। আর সেটা ভেসে উঠতে সে যেনো তার বাবার মন্ত্রগুপ্তির মতো আউড়ানো কথাগুলো শুনতে পায়: “তৈমূরের রক্ত আমার ধমনীতে প্রবাহিত।” নিজের অজান্তে সে কথাটার পুনরাবৃত্তি শুরু করে, প্রথমে আস্তে আস্তে পরে সেখানে প্রত্যয়ের বরাভয় বেশ অনুভব করা যায়। তৈমূর আর তার বাবা দু’জনের প্রত্যাশাই সে সফল করবে। বুক টান করে দাঁড়িয়ে ধূলিধূসরিত অশ্রুসিক্ত মুখ আলখাল্লার হাতায় মুছে নিয়ে সে ঘুরে দাঁড়ায়। “এইমাত্র এখানে যা ঘটে গেছে সেটা আমিই আম্মাজানকে বলবো।”