“আব্বাজান-”
“আমরা সবাই যদিও তৈমূর বংশের শাহ্জাদা।” আবেগের আতিশয্যে তাকে থামিয়ে দিয়ে সুলতান বলতে থাকেন, তার সাথে আমাদের কাকে তুলনা করবে? তার বিশাল সাম্রাজ্যের ক্ষুদ্র ভূখণ্ড নিজেদের আয়ত্ত্বে রাখতে আমরা মামুলি গোত্রপতিদের মতো নিজেদের ভিতরে তুমুল ঝগড়ায় ব্যস্ত। বাকি সবার মতো আমিও একই দোষে দোষী।” তার কণ্ঠস্বরে এবার ক্রোধের রেশ পরিষ্কার টের পাওয়া যায়। “তৈমূর যদি আজ জীবিত থাকতেন তবে এই মূর্খতার কারণে আমাদের মুখ দর্শন করতেন না। মির্জা বলে নিজেদের পরিচয় দিতে আমরা গর্ববোধ করি, ‘আমিরের বংশধর, তাকে আমাদের পূর্বপুরুষ হিসাবে উল্লেখ করতে ব্যগ্র হয়ে থাকি, কিন্তু তিনি কি আমাদের নিজের বংশধর বলে স্বীকার করতেন? নিজেদের মহত্ত্ব আর উত্তরাধিকার খুইয়ে ফেলার কারণে কি আমাদের তার সামনে নতজানু হয়ে করুণা ভিক্ষা করা উচিত না?”
সুলতান কঠোর হাতে বাবরের কাঁধ এতো জোরে আঁকড়ে ধরেন যে সে ব্যথা পায়। “বোঝার মতো বয়স তোমার এখন হয়েছে। আমি সে কারণেই এসব কথা তোমাকে বলছি। আমরা তৈমূরের কাছে ঋণী। বাছা আমার, তিনি ছিলেন একজন মহান মানুষ। তোমার ধমনীতে তার রক্তই বইছে। এটা কখনও ভুলে যেয়ো না। যদি পার তারমতো হতে চেষ্টা করবে। তোমার নিয়তির প্রত্যাশা যেনো পূর্ণ হয়, আর সেটা যেনোনা হয় আমার চেয়ে বড়।”
“আব্বাজান আমি চেষ্টা করবো… আমি কথা দিলাম।”
বাবরের চোখের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে সুলতান কিছু একটা দেখতে চান। তারপরে সন্তুষ্টচিত্তে, একটা অব্যক্ত শব্দ করে তিনি ঘুরে দাঁড়ান। বাবর সেখানেই চুপ করে বসে থাকে। তার বাবার অপ্রত্যাশিত আবেগ বোধহয় তাকেও স্পর্শ করেছে। তিনি এইমাত্র যা বলে গেলেন সেটা আত্মস্থ করার ফাঁকে, সে তাকিয়ে দেখে যে সূর্য প্রায় অস্তমিত হয়েছে। অন্যান্য দিনের সন্ধ্যার মত, গোধূলির শেষ আলোয় সে দেখে উঁচু-নিচু দৃশ্যপট আবছা হয়ে এসেছে। আধো-অন্ধকার প্রেক্ষাপটের ভেতর থেকে বের হয়ে এসে রাখাল বালকের দল তাদের ভেড়া আর ছাগলের পাল নিয়ে গ্রামের দিকে ফিরে যায়। সেইসাথে কবুতরের ব্যগ্র জোরাল ডাক ভেসে আসে। তার বাবার প্রিয় সাদা পায়রার দল চবুতরায় ফিরে ডানা ঝাপটাচ্ছে।
তার বাবার ঠোঁট থেকে একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসবার শব্দ বাবরের কানে আসে, যেন সে স্বীকার করে যে জীবনের প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসাব মেলানো এখনও বাকী আছে। সে সুলতানকে তার কোমরে ঝোলান চামড়ার ছোট বোতল থেকে একঢোক পানি পান করতে দেখে এবং মুখাবয়বে আবার প্রশান্তির ভাব ফুটে উঠতে, তিনি ঘুরে দাঁড়ান এবং দেয়ালের শীর্ষভাগে অবস্থিত চোঙাকৃতি কবুতরের বাসার দিকে ছাদের উপর দিয়ে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে যান, যা নিচের শুষ্ক গিরিখাদের উপরে আংশিক ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। পোড়া মাটির মেঝেতে তার পায়ের সোনার জরি দেয়া লাল মখমলের নাগরার শব্দ শোনা যায় এবং তার প্রিয় কবুতরকে উড়ে এসে হাতে বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে আর তাদের নধর গলায় প্রেমিকের কোমলতায় হাত বুলিয়ে দেবার অভিপ্রায়ে তিনি ইতিমধ্যে দু’হাত প্রসারিত করে দিয়েছেন। বাবর পুরো বিষয়টার ভিতরে কোনো আকর্ষণ খুঁজে পায় না। নধর মাংসের উড়ন্ত দেহ। তাদের জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা হলো পালক ছাড়িয়ে নিয়ে আখরোট গুঁড়ো আর ডালিমের আখনিতে হাল্কা আঁচে জ্বাল দেয়া।
বাবরের কল্পনায় আবার তৈমূর আর তার পরাক্রমশালী বাহিনী ফিরে আসে। সারা পৃথিবী তোমার, এমন অনুভূতির আমেজটা কেমন? কোনো শহর দখলের পরে শহরের সুলতানকে তোমার পায়ের কাছে কাতরাতে দেখা? তার বাবার কথাই ঠিক। ছোট্ট এই ফারগানার শাসক হবার থেকে কি আলাদা সে অভিজ্ঞতা। আব্বাজানের দরবারের তুচ্ছ রাজনীতির মারপ্যাঁচ দেখে সে বিরক্ত। প্রধান উজির কামবার-আলী যার ঘামে ভেজা আলখাল্লা থেকে সবসময়ে বুড়ো খচ্চরের মত দুর্গন্ধ বের হয়। হলুদ হয়ে যাওয়া লম্বা দাঁতের কারণে তাকে অবশ্য সেরকমই দেখায়। আর সবসময়েই সে বিপদের আঁচ পাচ্ছে। রক্তলাল চোখে সে সবসময়ে ব্যগ্র কেউ তাদের কথা শুনছে কি না খুঁজতে। তার বাবার কানের কাছে অনবরত ফিসফিস করে কথা বলে চলেছে। তৈমূর এই কুৎসিত নির্বোধটার মাথা বিন্দুমাত্র ভাবনার অবকাশ না দিয়ে ধড় থেকে আলাদা করে দিতেন। বাবর ভাবে, অচিরেই, যখন সে সুলতানের পদে অভিষিক্ত হবে, সম্ভবত সে নিজেই সেটা করবে।
শীঘ্রই নামাযের ওয়াক্ত হবে আর তারপরে জেনানামহলে খেতে যাবার সময়। সে সিঁড়ির ধাপ থেকে লাফিয়ে নামে। ঠিক সেই মুহূর্তে প্রচণ্ড শব্দে সে কিছু একটা ভেঙে পড়তে শোনে, তার পায়ের নিচে ছাদের মেঝে কেঁপে উঠে। কয়েক লহমা পরে কিছু একটা ধ্বসে পড়ার ভেতা আওয়াজ ভেসে আসে। একহাত দিয়ে দেয়াল ধরে সে নিজেকে আগে ধাতস্থ করে এবং বুঝতে পারে চোখে কিছু দেখছে না। এসব কিসের আলামত? মাঝে মাঝে দূর্গকে যা কাঁপিয়ে তোলে সেরকম আরেকটা ভূমিকম্প? না, এবারের শব্দটার ধরণ আলাদা ছিলো। অভিঘাতের উত্তেজনায় সে নিজের অজান্তেই শ্বাসরোধী ধূলিকণা বুকে টেনে নেয় আর চোখ ছাপিয়ে পানির ধারা নেমে আসে দৃষ্টি স্বচ্ছ করার অভিপ্রায়ে। সহজাত প্রবৃত্তিতে বাবর মাথা আর মুখ আড়াল করে। এমন সময়ে সে দ্রুত কারো দৌড়ে আসবার শব্দ শুনতে পায়। এবং টের পায় একজোড়া শক্ত হাত তাকে আঁকড়ে ধরে এবং তুলে পেছনে নিয়ে আসে। “শাহজাদা, আপনি এখন নিরাপদ।”