*
দুইদিন পরে, হুমায়ুন কর্পূরে ধোয়া বাবরের মৃতদেহ নরম উলের কাপড়ে মুড়িয়ে রূপার কফিনে নানা সুগন্ধির সাথে ছয়জন সেনাপতি স্থাপন করলে দাঁড়িয়ে দেখে, কফিনটা বারোটা কালো ষাঁড়ে টানা গাড়ির উপরে রাখা। তারপরে ঢোলের মৃদু শব্দের সাথে হিন্দুস্তানের ধূধূ প্রান্তর, সিন্ধু নদ অতিক্রম করে খাইবার গিরিপথের আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করে উত্তর-পশ্চিমে কাবুলের দিকে শববাহী বহরটা যাত্রা শুরু করে। হুমায়ুন জানে মৃত্যুর পরে তার বাবার নিজের প্রিয় পাহাড়ী এলাকায় ফিরে যাবার ইচ্ছার ভিতরে কোনো বিরোধ নেই।
বাবরের কথামতো, তার দেহ কাবুলে পৌঁছাবার পরে পাহাড়ের ধারে বাবরের নিজের তৈরি উদ্যানে একটা সাধারণ মার্বেলের ফলকের নীচে তার বন্ধু বাবুরীর পাশে যেনো তাকে সমাহিত করা হয়। সেখানেই তার আম্মিজান আর নানীজানের কবর। বাবরের ইচ্ছা অনুসারে তার কবরের উপরে কোনো বড় সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হবে না। আকাশের বিশাল শামিয়ানার নিচে প্রথম মোঘল সম্রাটের সমাধি বাতাস আর বৃষ্টির মাঝে অবারিত থাকবে।
হুমায়ুন আড়চোখে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কামরান, আসকারী আর হিন্দালের দিকে তাকায়। তাদের বিষণ্ণ মুখ বলে দেয় তারাও তার মতো দুঃখী এবং এখনকার মতো তাদের ভিতরে কোনো বিভেদ নেই। কিন্তু এই একতার স্থায়িত্ব কতোদিন? তারা কি সাম্রাজ্য তাদের ভিতরে ভাগ না করে একা হুমায়ুনকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে গিয়েছেন বলে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে না। উচ্চাশা অভিযানের আকাক্ষা আর তার ফলে প্রাপ্ত ক্ষমতার মোহ তাকে বহুদিন ধরেই তাড়িত করছে- সেই একই ক্ষুধা তাদের ভিতরেও জাগ্রত হবে। বিশেষ করে কামরানের মাঝে, যে বয়সে প্রায় তারই সমান। কামরানের স্থানে থাকলে কি সেও ক্ষুব্ধ হতো না? কিংবা আসকারী? এমনকি পিচ্চি হিন্দালও শীঘ্রই পৃথিবীকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করবে। সম্রাটের সব সন্তানই চাইবে নিজের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যকে নতুন মহিমায় সিক্ত করতে। বাবরের স্মৃতি আর ভাই ভাইয়ের ভিতরে বিদ্যমান ভ্রাতৃত্ববোধ কতোদিন বজায় থাকবে। তারা হয়তো মাংসের চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা কুকুরের পালে পরিণত হবে। হুমায়ুন কি করছে বুঝতে পেরে সে সরে আসে। তখনও তার বাকি ভাইয়েরা শববাহী বহরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বহরটা একটা বাঁকের কাছে পৌঁছে আগ্রা শহরের ভিতর দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। পেছনে কেবল একটা কমলা রঙের ধূলোর মেঘ পড়ে থাকে।
“তোমার সৎ-ভাইদের বিরুদ্ধে কোনো ক্ষোভ পোষণ করবে না…তাদের ভালোবাসবে…তাদের ভিতরে সমঝোতা বজায় রাখবে…” হুমায়ুনের মাথার ভেতরে স্নেহপরায়ণ বাবার শেষ আদেশের কথা ঘুরতে থাকে। সে বাবরের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সেটা সে বজায় রাখবে। সেটা বজায় রাখাটা একটা কঠিন কাজ হবে এবং তাকে সংযমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে। বাবরের কথাগুলো একভাবে দেখতে গেলে একটা সতর্কবাণী…পুরুষানুক্রমে তৈমূরের বংশধরেরা নিজেদের ভিতরে লড়াই করে শেষ হয়ে গিয়েছে। ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে, এবং নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে তারা দুর্বল হয়ে পড়েছে। উজবেকদের মতো বহিঃশত্রুর সহজ শিকারে তখন তারা পরিণত হয়েছে। নতুন মোঘল সম্রাট হিসাবে সে হিন্দুস্তানে এই রীতির সূচনা করতে দিবে না। এটা তার পবিত্র দায়িত্ব।
হুমায়ুন তার হাতের তৈমূরের ভারী আংটিটা দেখে, একটা অনভ্যস্ত ওজন, যেখানে একটা বাঘের মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। অনেক লড়াই, অনেক বিজয়, আংটিটা দেখেছে…তার হাতে আংটিটা আর নতুন কি দেখবে। তার হাতে থাকা অবস্থায় এটা কি বিপর্যয় নাকি গৌরবের অংশীদার হবে। সেটা তার এখনই জানবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যাই ঘটুক সে তার বাবার স্মৃতি বা তার সাম্রাজ্যের জন্য কখনও অসম্মান বয়ে আনবে না। আংটিটা ঠোঁটের কাছে তুলে এনে তাতে আলতো চুমু খেয়ে সে নিরবে একটা প্রতিজ্ঞা করে: “আমি নিজেকে আব্বাজানের যোগ্য উত্তরসূরীতে পরিণত করবো এবং সারা পৃথিবী আমাকে সেজন্য স্মরণ করবে।”
.
ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা
বাবরের জীবন ছিলো যুদ্ধের রক্তে রাঙানো এক মহাকাব্য। তার জীবনে এত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো যে তিনি স্বয়ং সবকিছু তার স্বরচিত বাবরনামায় লিপিবদ্ধ করতে পারেননি। বাবরনামা ছিলো ইসলামের ইতিহাসের প্রথম আত্মজীবনী। বাবরনামায় তার জীবনের বেশকিছু সময়ের ঘটনার অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। এই সামান্য ত্রুটি বাদ দিলে বাবরের জীবনের সকল প্রধান ঘটনাই বাবরনামায় পাওয়া যায়। যেমন তিনবার সমরকন্দ দখল, উজবেকদের সাথে বাবরের সংঘাত, উত্তর-পশ্চিম ভারতে হিন্দু আধিপত্য খর্ব করে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা। সবকিছুই বাবরনামা আর অন্যান্য ঐতিহাসিক উৎস থেকে জানা যায়। আমি এই সব উল্লেখযোগ্য ঘটনা, তাদের ঐতিহাসিক পর্যায়ক্রম, বিচার বিশ্লেষণ, সংযোজন, পরিমার্জন করে এই গ্রন্থে বর্ণনা করেছি।
বাবরের নানী ছিলেন- এসান দৌলত, যার উপদেশ বাবর তরুণ বয়সে মেনে চলতো। বাবরের আম্মিজান- খুতলাঘ নিগার, বোন খানজাদা, তার বৈমাত্রেয় ভাই জাহাঙ্গীর, সবার অস্তিত্বই পাওয়া যায়। বাবরের পিতা আসলেই কবুতরের চবুতরা ভেঙে পড়ে নিহত হন। বাবরের ঐতিহাসিক শত্রু পারস্যের শাহ ইসমাইল, সাইবানি খান, দিল্লীর ইবরাহিম লোদী এইসব ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে এই উপন্যাস লিখিত হয়েছে। গল্পের ঘটনা প্রবাহের খাতিরে আরো কিছু নতুন চরিত্র সৃষ্টি করেছি, বাবরের জীবনে প্রভাবশালী লোকদের আদলে। ওয়াজির খান, বাইসানগার, বাবুরী তেমনই সব চরিত্র। অবশ্য বাবরনামাতে বাবুরী নামে একটা বাজারের ছেলের কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। সামাজিক আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যতোটা সম্ভব এই উপন্যাসে উলেখ করা হয়েছে। যেমন সুন্নী মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও সুরা, চরস, ভাণ প্রভৃতির প্রতি তার আসক্তির বর্ণনা বাবরনামায় পাওয়া যায়। এই উপন্যাসে অটোমান সাম্রাজ্য হতে প্রাপ্ত অস্ত্র আর সেটা ব্যবহারে বাবরের দক্ষতার তথ্য সত্য ঘটনার উপরে প্রতিষ্ঠিত।