বাবর দম নেবার জন্য একটু চুপ করে। “আমি কিছুদিন যাবৎ হুমায়ুনের সাহস আর তার প্রজ্ঞার জন্য তাকেই আমার উত্তরাধিকারী বলে মনে মনে ভাবছিলাম…কিন্তু নিজে প্রাণশক্তি, কামনা বাসনার কারণে প্রতারিত হয়ে সেটা আমি তোমাদের জানাতে পারিনি। আমি এখন সেটা বলছি। আমি হুমায়ুনকে আমার উত্তরাধিকারী মনোনীত করলাম। তোমাদের সামনে তার নাম সুপারিশ করছি। আমাকে যেমন আনুগত্য আর সাহসিকতার সাথে অনুসরণ করেছো, কথা দাও তাকেও সেভাবে অনুসরণ করবে। তার প্রতি অনুগত থাকার শপথ নাও।”
দরবার এক মুহূর্ত নিশ্চুপ থাকে তারপরে একটা সম্মিলিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়: “সম্রাট আমরা আনুগত্যের শপথ নিলাম।”
“হুমায়ুন আমার হাত থেকে তৈমূরের আংটিটা খুলে নাও। এটা এখন তোমার। গর্বের সাথে এটা পরিধান করবে। আর কখনও নিজের প্রজা আর সাম্রাজ্যের প্রতি দায়িত্বের কথা বিস্মৃত হয়ো না। তোমরা সবাই আমার কথা শুনতে পেয়েছো?”
“হ্যাঁ, সম্রাট।”
“বেশ, আমাকে এবার হুমায়ুনের সাথে কিছুক্ষণ একলা থাকতে দাও। আমি আমার ছেলের সাথে একটু একা থাকতে চাই…”।
বাবর চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করে। সে গালিচার উপরে দ্রুত পায়ের শব্দ শুনতে পায় এবং তারপরে দরজা বন্ধ হবার শব্দে সবকিছু নিরব হয়ে যায়। তারা কি বিদায় নিয়েছে?”
“হ্যাঁ, আব্বাজান।”
“আমার কথা মন দিয়ে শোনো। আমি তোমাকে অন্য বিষয়ে কিছু বলতে চাই। প্রথমে নিজেকে ভালো করে জানতে চেষ্টা করবে এবং কিভাবে কোনো দুর্বলতা থাকলে সেটাকে অতিক্রম করা যায়…কিন্তু তারচেয়ে বড় কথা, যেকোনো মূল্যে সাম্রাজ্যের ঐক্য রক্ষা করবে। আমি বোকা নই, আমি জানি তোমার সৎ-ভাইরা ঈর্ষান্বিত হবে। তাদের প্রাপ্য তাদের দিবে এবং যতোক্ষণ সম্ভব তাদের সহ্য করবে তোমার পক্ষে যতটা সম্ভব। তাদের ভিতরে সমঝোতা তৈরির প্রয়াস নিবে, তাদের বড়ভাইয়ের মতো ভালোবাসবে। মনে রেখো তৈমূর যে আদি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছে, সেখানে শাহজাদাদের প্রাণ পবিত্র বলে গণ্য করা হয়…হুমায়ুন আমাকে কথা দাও…আমার কথা তুমি পালন করতে চেষ্টা করবে।”
বাবরের আবার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। সে হুমায়ুনের কোনো কথা শুনতে পায় না। “আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না।”
“আব্বাজান আপনি শান্ত হোন, আমি আপনাকে কথা দিলাম।”
বাবরের দেহ তাকিয়ার উপরে নেতিয়ে পড়ে। তার মুখে প্রশান্তির ভাব ফুটে উঠে। কিন্তু তারপরে সে আবার কথা বলতে থাকে। আর একটা বিষয়। আমাকে এখানে হিন্দুস্তানে সমাহিত করবে না। এটা তোমার আর তোমার সন্তানদের মাতৃভূমিতে পরিণত হবে। কিন্তু এটা আমার মাতৃভূমি না। আমার দেহ কাবুলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে…আমি আমার রোজনামচায় আমার শেষ ইচ্ছার কথা লিখে গিয়েছি…”
হুমায়ুন এবার ফোঁপাতে শুরু করে।
“আমার জন্য দুঃখ কোরো না। তুমি যখন অসুস্থ হয়েছিলে আমি এটাই কামনা করেছিলাম। তোমার জ্যোতিষি আমাকে বলেছিলো কি করতে হবে- আমাকে আমার প্রিয় জিনিসটা উৎসর্গ করতে হবে। আমি তোমার জীবনের বদলে আল্লাহকে আমার জীবন সমর্পণ করেছি এবং এজন্য আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই। আল্লাহ করুণাময়। তিনি তার কাছে আমাকে ডেকে নেবার আগে তোমার সাথে নিভৃতে সময় কাটাবার সুযোগ দিয়েছেন…”
হুমায়ুন তার বাবার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকায়। সে তাকে কিভাবে বলবে যে জ্যোতিষি এটা বোঝাতে চায়নি। লোকটা পরে তাদের ভিতরের কথোপকথনের কথা হুমায়ুনকে বলেছে। লোকটা তাকে তার সম্পদ, কোহ-ই-নূর দান করার কথা বোঝাতে চেয়েছিলো তার নিজের জীবন উৎসর্গ করতে বলেনি…
কিন্তু তার আব্বাজানের শুকনো ঠোঁটে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠে এবং সে আবার কথা বলতে চায়। “দুঃখ কোরো না। এর মানে স্রষ্টা আমার কথা শুনেছেন…আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে তার সান্নিধ্যে যাব… আমি এখন জানি আমার শুরু করা কাজ তুমি এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারা সবাই, যারা আমার আগে মারা গিয়েছে, বেহেশতে আমার জন্য অপেক্ষা করছে…আমার বাবা-মা, নানীজান, ওয়াজির খান, আমার বন্ধু বাবুরী…এমনকি চোখে মোমবাতির আলোর মতো ম্লান আভা নিয়ে তৈমূরও অপেক্ষা করছে…তার সাথে আমার দেখা হলে তাকে আমাদের অর্জনের কথা। জানাবো…কিভাবে তারই মতো আমরা সিন্ধু অতিক্রম করে বিশাল একটা বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিলাম…কিভাবে আমরা…”
বাবর অনুভব করে একটা উষ্ণ শান্তি তাকে আবৃত করে নেয়। সে ডুবতে শুরু করে, ভেসে যেতে থাকে, তার চেতনা লুপ্ত হতে শুরু করে। বাবর আর কি বলতে হুমায়ুন সেটা আর কখনও জানতে পারবে না। একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাসের মাধ্যমে তার আব্বাজান হইধাম ত্যাগ করে এবং তার মাথাটা সামনে ঝুঁকে আসে।
হুমায়ুন নিজের মাথা নীচু করে দোয়া করতে থাকে: “আমার আব্বাজানকে দ্রুত বেহেশতের প্রশান্তিময় বাগিচায় পৌঁছে দাও। আমাকে তার আরাধ্য কাজ সমাপ্ত করার তৌফিক দান কর, যেনো উপর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে তিনি গর্ব অনুভব করেন…আমাকে শক্তি দাও…”
অবশেষে উঠে দাঁড়িয়ে হুমায়ুন শেষবারের মতো বাবরের দিকে তাকায়। তারপরে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তার চোখে আবার অশ্রু টলটল করতে থাকে এবং সে বহু কষ্টে নিজের। কণ্ঠস্বর সংযত রাখে। “আব্দুল-মালিক,” সে ডাকে, “সম্রাট মারা গেছেন…সবাইকে খবর পাঠাও…”