তারপরে আরেকটা ভাবনা তার মনকে আপুত করে। আল্লাহতালা সম্ভবত হুমায়ুনের প্রাণের বিনিময়ে তার নিজের জীবন উৎসর্গের প্রতিশ্রুতির কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। সম্ভবত তার ধারণাই ঠিক, হুমায়ুনের অলৌকিক আরোগ্য লাভে স্বস্তি আর উল্লাসে ৰিক্ত হয়ে সে ভেবেছিলো আল্লাহ বোধহয় তার আকুল প্রার্থনা শুনেছেন…যদি তাই হয়ে থাকে তবে তার জীবনের সেরা কীর্তি বলে এটা বিবেচিত হবার যোগ্যতা রাখে। কারণ আল্লাহতালা হুমায়ুনের ভিতরেই সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত নিরাপদ বলে। বিবেচনা করেছেন। সম্ভবত এটা স্রষ্টার লীলাখেলার একটা মহিমা। অবশেষে তার জীবন একটা পরিণতি লাভ করলো। ভাবনাটা তাকে আবেগপ্রবণ করে তোলে। বাবর শুয়ে থাকে। অবজ্ঞা আজ্ঞায় রূপান্তরিত হতে থাকে, তার ক্লান্ত মনে একটা বিজয়ের অনুভূতিও মাঝে মাঝে উঁকি দেয়। সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপনের পরে তার মৃত্যুতে এখন আর কিছু আটকে থাকবে না।
তারপরে তার মনকে একটা নতুন ভাবনার দ্যোতনা সহসা আরো পরম মাত্রায় অসাড় করে ফেলে। ভাগ্যের লিখন বা প্রতিজ্ঞার পালন যেভাবেই তার মৃত্যু হোক, হুমায়ুনের অবস্থান তাকে সুরক্ষিত করে যেতে হবে। নতুবা মোঘল সাম্রাজ্য কুড়িতেই বিনষ্ট হবে। ঠিক তৈমূরের সাম্রাজ্যের মতো নিজের সন্তান আর অনুগত শাসকদের বিদ্রোহের ফলে। হুমায়ুনকে তার একমাত্র উত্তরাধিকারী ঘোষণা করতে হবে…তার সেনাপতি আর অমাত্যদের হুমায়ুনের প্রতি আনুগত্য নিশ্চিত করতে হবে…যতোটুকু সময় তার হাতে আছে এর ভেতরেই তাকে সম্ভব সব পরামর্শ দিয়ে যেতে হবে…।
বাবর আবার ঘামতে শুরু করে। তার নাড়ীর বেগ বাড়তে থাকে এবং ব্যাথার প্রকোপ পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করে। নিজের পুরোটা মানসিক দৃঢ়তা প্রয়োগ করে…যা কোনো যুদ্ধ জয়ের চেয়ে কম না…নিজের দেহের উপরে মনের আধিপত্য বিস্তার করা কিন্তু সে নিজেকে প্রবোধ দেয় তাকে কেউ কাপুরুষ বলবে না। সে বিছানার উপরে উঠে বসে। “আমার মন্ত্রণাসভা আহ্বান করো। তাদের সাথে আমাকে কথা বলতে হবে… একজন প্রতিলিপিকারীকে উপস্থিত থাকতে হবে। আমার প্রতিটা কথা লিপিবদ্ধ করার জন্য। কিন্তু তার আগে আমাকে খানজাদার সাথে নিভৃতে কথা বলতে হবে…তাকে দ্রুত আমার কাছে নিয়ে এসো।”
সে অপেক্ষা করার সময়ে কি বলবে মনে মনে গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার মন বারবার বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।
“বাবর…” খানজাদার কণ্ঠস্বরে তার ঘোর কাটে।
“বোন, বহুবছর আগে তুমিই প্রথম আমার দোলনায় আমাকে সবার আগে আমাকে দেখেছিলে…তারপর থেকে আমরা অনেক কষ্ট সহ্য করেছি, আর অনেক কিছু অর্জনও করেছি। অনেক ভাইয়ের মতোই আমি কখনও তোমাকে বলিনি যে, আমি তোমাকে কতোটা ভালবাসি…পছন্দ করি…আমি এখন সেটা বলছি…এখন যখন আমার মনে হচ্ছে মৃত্যু খুব নিকটে ওঁত পেতে আছে। আমার জন্য দুঃখ কোরো না…মরতে আমি ভয় পাই না, আমি চিন্তিত আমার মৃত্যুর পরে এই সাম্রাজ্যের পরিণতি নিয়ে। আমার ইচ্ছা হুমায়ুন আমার উত্তরসূরী হোক। কিন্তু আমার মনে হয় তার ভাইয়েরা সেটা মেনে নেবে না…তারা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে। আমার সব সন্তানদের কাছে তুমিই তাদের একমাত্র রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়। তারা তোমাকে শ্রদ্ধা করে…পরিবারের জন্য তোমার আত্মত্যাগের কথা বলে তোমাকে ছোট করবো না…আর তাই তারা তোমার কথা শুনবে…আমাকে যেমন একসময়ে দেখে রেখেছিলে, তাদেরও সেভাবে দেখে রেখো…তাদের ঐতিহ্যের কথা সবসময়ে তাদের স্মরণ করিয়ে দেবে। আর তাদের অবশ্যই তাদের কর্তব্যের কথাও…আর তাদের মায়েরা যেনো বিদ্রোহের উসকানি দিতে না পারে…”
বাবর ক্লান্ত হয়ে পড়লে, একটু চুপ করে।
“ছোট ভাইটি আমার আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি।” খানজাদা আলতো করে তার কপালে চুমু খেলে সে আর্দ্রতা টের পায়- খানজাদার অশ্রু- তার গালে স্পর্শ করছে।
“বোন, আমরা অনেকদূর পথ অতিক্রম করেছি, তাই না?” সে ফিসফিস করে বলে। দীর্ঘ আর কখনও কষ্টদায়ক পথ। কিন্তু সেটাই আমাদের পরিবারকে একটা মহিমান্বিত গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে…এখন আমার পরিচারকদের বলো আমাকে দরবারের আনুষ্ঠানিক আলখাল্লা পরিয়ে দিতে। আমার হাতে সময় বড় অল্প। আমি তার আগেই আমার অমাত্যদের সাথে কথা বলতে চাই…”।
সোয়া ঘণ্টা পরে, অমাত্যরা যখন দরবারে প্রবেশ করে বাবরকে তার সবুজ আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় সিংহাসনে উপবিষ্ট দেখা যায়, তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে আছে। তারা ভেতরে প্রবেশ করতে বাবর চোখ বন্ধ করে এবং বহু কষ্টে নিজেকে সজাগ রাখে। তাকে পরিষ্কার করে চিন্তা করতে হবে। সে তার চারপাশে একটা গুঞ্জন শুনতে পায়। “আব্বাজান, সবাই এসেছে।”
চোখ খুলে তাকিয়ে বাবর বুঝতে পারে তার চোখের দৃষ্টি পুরোপুরি পরিষ্কার না…কোনো ব্যাপার না। ব্যাপার হলো তারা তার কথা যেনো পরিষ্কার শুনতে পায়। সে তার হাঁসফাঁস করতে থাকা বুক ভরে শ্বাস নেয় এবং শুরু করে: “আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন আমি অসুস্থ…আমার জীবন এখন আল্লাহর হাতে। আমি যদি মারা যাই, তাহলে আমাদের এই এতো পরিশ্রম যেনো উত্তাপ আর ধূলোতে বিলীন না হয়ে যায়…সেটা রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের উপরে থাকবে। আভ্যন্তরীণ কলহ পাত্তা না দিয়ে এখনকার মতোই সবাই একতাবদ্ধ থাকবে। সেটা অর্জন করতে হলে তোমাদের জানা উচিত কে আমার উত্তরাধিকারী হবে।”