বাবর তার রোজনামচার পাতার দিকে তাকায়, নীচু টেবিলের উপরে খোলা পড়ে রয়েছে। কি আহাম্মকি না সে করেছিলো হুমায়ুনকে এটার প্রতিলিপি দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে, যে একদিন এটা তাকে শাসনকার্যে সহায়তা করবে। তার মনেই হয়নি যে, সে শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করার মতো দীর্ঘ দিন জীবিতই থাকবে না। তার ইচ্ছা করে হুমায়ূনের কামরায় জ্বলতে থাকা গনগনে আগুনে রোজনামচাটা নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়…কিন্তু হুমায়ুনের কামরায় যাবার মতো সাহস তার ভিতরে আর অবশিষ্ট নেই যে, সেখানে গিয়ে চিত্তবৈকল্যের যন্ত্রণায় কাঁপতে দেখে।
“সুলতান…”
বাবর ঘুরে দাঁড়ায়। হেকিমের এক সহকারী তার সাথে দেখা করতে এসেছে। লোকটাকে ক্লান্ত দেখায়, তার চোখের নীচের ত্বক এতোটাই কালো যেনো কালশিটে পড়েছে। “আমার প্রভু বলে পাঠিয়েছেন যে আপনার একবার যাওয়া উচিত…”
বাবর দৌড়ে হুমায়ুনের কামরায় যায়।
আব্দুল-মালিক কক্ষের দরজায় তার জন্য অপেক্ষা করছে। হাত পেটের উপর আড়াআড়ি করে রাখা। “সুলতান…আপনার ছেলে বিকট চিৎকার করেছিলো…এবং আমি ভেবেছিলাম- আমি সত্যিই ভেবেছিলাম-তার অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে…তারপরে সে চোখ খুলে তাকায় এবং আমাকে চিনতে পারে…এবং যেমন আকস্মিকভাবে জ্বর এসেছিলো, ঠিক তেমনি আকষ্মিকভাবে সেটা ছেড়ে গিয়েছে…” হেকিম তার মাথা নাড়ে, তাকে একাধারে বিস্মিত আর উফুল্ল দেখায়। “আমি আমার জীবনে এমন কিছু দেখিনি, সুলতান…এটা একটা অলৌকিক ঘটনা।”
*
আগ্রা দূর্গের পাদদেশে সূর্যালোকিত নদীর তীরে ঘোড়া ছোটায় হুমায়ুন। তার দাস্তানা পরিহিত হাতে লাল চামড়ার ঘোমটা মাথায় দিয়ে চুপ করে কালো বাজপাখিটা বসে রয়েছে। বাবর ভাবে পরে সে তার সাথে যোগ দেবে। বহুদিন হয় সে বাজপাখি উড়ায়নি। কিন্তু তার আগে সে যমুনার তীরে তার উদ্যান পরিদর্শনে যাবে। সেখানে সে মালিদের সাথে আখরোটের গাছ লাগাবার বিষয়ে শলাপরামর্শ করবে। সে ধীরে ধীরে হুমায়ুনের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। অসুস্থতা থেকে অলৌকিকভাবে সেরে ওঠার মাত্র চারমাস পরে তাকে আবার আগের মতো প্রাণবন্ত আর শক্তিশালী দেখাচ্ছে।
বাবর দূর্গের দেয়ালের পাদদেশে নেমে যাওয়া বেলে পাথরের বাঁকানো সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। সিঁড়ির কয়েক ফিট দূরে, আরো কয়েকটা ছত্রাকে ছাওয়া এবং সংকীর্ণ ধাপের পরে সেটা নদীর ঘাটে গিয়ে মিশেছে। যেখানে তার সোনার পানি দিয়ে নকশা। করা বজরা অপেক্ষা করছে নদীর ওপারে তাকে পৌঁছে দেবার জন্য। হঠাৎ তার পেটে প্রচণ্ড একটা যন্ত্রণা হতে সে কুঁকড়ে যায় এবং হাত বাড়িয়ে পাথরের রেলিয়ের পরিক্ষেপ আঁকড়ে ধরে। ব্যাথা কমতে শুরু করলে, সে গভীরভাবে দম নিতে থাকলে ব্যাথাটা আবার ফিরে আসা ঢেউয়ের মতো তার পুরো শরীরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সে মাতালের মতো টলতে থাকে…”আমাকে ধরো…’
শক্ত হাত তার বাহুর নীচে তাকে জড়িয়ে ধরে, টেনে তোলে। কে এটা? সে কৃতজ্ঞ চিত্তে মুখ তুলে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পায় না, কেবল চরাচরগ্রাসী একটা অন্ধকার।
*
“তার পেটে বায়ু চলাচল করছে না…তিনি প্রশ্রাবও করেননি…তিনি কিছু খাচ্ছেনও না। ছত্রিশ ঘণ্টা কেবল সামান্য পানি ছাড়া আর কিছুই তিনি মুখে দেননি…বুয়ার সেই বিষের ফলে এটা হচ্ছে কিনা আমি বলতে পারবো না…”।
বাবর তার চারপাশে উদ্বিগ্ন, চাপা কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। এরা কাকে নিয়ে কথা বলছে? তার মুখ আর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে…তার শুকনো ঠোঁটের মাঝে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে যায়। সে ঢোক গিলতে চেষ্টা করে, কিন্তু সেটা কষ্টকর বলে প্রতিপন্ন। হয়…সামান্য সময়ের জন্য তার চোখের পাতা মিটমিট করে। তার মুখের উপরে ঝুঁকে থাকা অবয়বগুলো ধোঁয়াটে আর অস্পষ্ট। সে আরও পানির স্বাদ অনুভব করে- কেউ একজন আলতো করে তার মুখে একটা চামচ প্রবেশ করায়…সে এবার বুঝতে পারে লোকটা কে, আর সে কোথায় আছে…সে একটা গুহার ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে যেখানে শত্রুরা তাকে খুঁজে পাবে না। ওয়াজির খান হাঁটু মুড়ে তার পাশে বসে রয়েছে, ফোঁটা ফোঁটা পানি তার ঠোঁটে দিচ্ছে। সে সুস্থ হয়ে উঠলে তারা একসাথে ফারগানায় ফিরে যাবে…
“ওয়াজির খান…? সে কোনোমতে গুঙিয়ে উঠে। “ওয়াজির খান…” সে আবার চেষ্টা করে। এবার আগের চেয়ে স্পষ্ট বোঝা যায় তার কণ্ঠস্বর।
“না, আব্বাজান আমি হুমায়ুন।”
হুমায়ুন আবার কোথা থেকে এর ভেতর এলো, বাবর ঠিক বুঝতে পারে না।
“আপনার বেটা।”
এইবার সে বুঝতে পারে। অনেক কষ্টে বাবর নিজেকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনে। সবুজ চোখ খুলে এবং আতঙ্কিত ছেলেকে পাশে বসে থাকতে দেখে। “কি…আমার কি হয়েছে…?”
“আব্বাজান, আপনি অসুস্থ। আপনি চেতন অচেতনের মাঝে ঘোরাফেরা করছেন…অসুস্থ হবার পরে আপনার চারবার আক্রমণ হয়েছে। প্রতিটা আগেরটার চেয়ে ভয়ঙ্কর। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি…কিন্তু দুশ্চিন্তা করবেন না…আব্দুল-মালিক এখনও আশাবাদী। তিনি তার সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন।”
কয়েক ঢোক পানি পান করে- সে এটাই কোনোমতে গিলতে পারছে- বাবর আবার বিছানায় এলিয়ে পড়ে, সে টের পায় অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু তার ইন্দ্রিয়ের সাড়া আবার ফিরে আসছে। সে নিশ্চয়ই মারাত্মক অসুস্থ… সম্ভবত এতোটাই যে, তার। মৃত্যুও হতে পারে… সম্ভাবনাটা তার মাঝে অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা কাঁপুনির জন্ম দেয়। আসলেই কি অবস্থা এতোটাই খারাপ? তার বিকাশমান সাম্রাজ্যে যখন অনেক কাজ বাকি তখনই তাকে চলে যেতে হবে…জীবনটা উপভোগই করা হলো না। সে তার ছেলেদের পরিণত অবস্থায় দেখতে চায়। আল্লাহতা’লা নিশ্চয়ই তাকে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবেন না…