পরবর্তী আধঘণ্টা বাবর ঝিরঝির বৃষ্টি পড়তে থাকা আঙ্গিনায় অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করে কাটায় এবং হেকিম হারামজাদার ঘাড় ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনে তার মুখ থেকে কি হয়েছে শোনার আকাঙ্ক্ষা বহু কষ্টে দমন করে। কিন্তু আব্দুল-মালিকই শেষ পর্যন্ত এসে উপস্থিত হয়। বাবর বৃথাই তার মুখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করে।
“শাহজাদার প্রচণ্ড জ্বর আর তিনি প্রলাপ বকছেন…”
“কি হয়েছে? কেউ বিষ দেয়নি নিশ্চয়ই?”
“না, সুলতান, বমি হচ্ছে না। আমি অবশ্য কারণও বলতে পারবো না। আমরা কেবল ঘামের সাথে সংক্রমণটা বের করে দেবার চেষ্টা করতে পারি। আমি তার ঘরে আগুন জ্বালাবার আদেশ দিয়ে এসেছি এবং তার রক্তকে আরও উত্তপ্ত করে তোলার জন্য আমি বিভিন্ন মশলা দিয়ে একটা আরক তৈরি করবো…”
“আর কিছু করার নেই? আমি কি কাউকে ডেকে পাঠাবো?”
“না, সুলতান। আমাদের ধৈর্যধারণ করতে হবে। আল্লাহতালা যেমন আমাদের সবার ভাগ্য নির্ধারণ করেন, তেমনি কেবল তিনিই তার ভাগ্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।”
সারারাত ধরে, আব্দুল-মালিক আর তার সহকারীরা হুমায়ুনের শুশ্রূষা করে। কামরার ভেতরের প্রায় শ্বাসরোধকারী গরমের ভিতরে, বাবর বিছানার কাছে বসে দেখে তার জোয়ান মর্দ ছেলে এপাশ ওপাশ করছে, ছটফট করছে। হেকিমের নির্দেশে তার গায়ে সে ভারী কম্বল চাপানো হয়েছে সেটা ফেলে দিতে চেষ্টা করছে। হুমায়ুন থেকে থেকেই বিড়বিড় করে মাঝে মাঝে সেটা চিৎকারে পরিণত হয়। বাবর অবশ্য শব্দগুলো কিছুই বুঝতে পারে না।
ভোর হবার ঠিক আগে, পূর্বাকাশে হলুদাভ রূপালী আলোর আভা ফুটে উঠতে হুমায়ুনের চিত্তবৈকল্য আরো বৃদ্ধি পায়। তার খিচুনি শুরু হয়। যেনো প্রচণ্ড যন্ত্রণা পাচ্ছে এবং এতো জোরে কাঁপতে থাকে যে, আব্দুল-মালিকের সহকারী তাকে জোর করে চেপে ধরে না থাকলে, সে হয়তো বিছানা থেকে নীচে পড়ে যেতো। তার চোখ কোটর থেকে বের হয়ে এসেছে এবং তার জিহ্বা- হলুদ আর ফোলা ফোলা- শুকনো ঠোঁটের মাঝে বেরিয়ে রয়েছে।
আচমকা ছেলের কষ্টের এই দৃশ্য আর আর্তনাদ বাবরের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে আসে। বাইরের আঙ্গিনায় সে ঝর্ণার এটা পদ্মফুলের বেসিনের উপরে ঝুঁকে এবং পানির নীচে মাথা ডুবিয়ে দেয়। শীতল পানি তার নাক আর কানে প্রবেশ করতে, মনে হয় যেনো- অন্তত এক মুহূর্তের জন্য হলেও-সে পৃথিবীর যাবতীয় উৎকণ্ঠা আর যন্ত্রণা থেকে নিজেকে আড়াল করতে পেরেছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে পানির ভেতর থেকে মাথা তুলে এবং চোখ থেকে পানি মোছে।
“সুলতান, মার্জনা করবেন…”।
বাবর ঘুরে তাকায়। হুমায়ুনের জ্যোতিষীর ছোটখাট অবয়ব পরণে মরিচা রঙের আলখাল্লা, যা তার আকৃতির তুলনায় বড় দেখায় তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাবর মুখের উপর থেকে ভেজা চুল সরিয়ে দেয়। “কি বলতে চাও?”
“সুলতান, আমি গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান পর্যালোচনা করছিলাম, আমার প্রভুর ভাগ্যে বিধাতা কি লিখেছেন বোঝার জন্য। আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। আপনার ছেলের জীবন এখন আপনার হাতে। আপনি যদি তাকে জীবিত দেখতে চান আপনাকে অবশ্যই মহান আত্মত্যাগ করতে হবে…”
“তাকে বাঁচাবার জন্য আমি সব করতে রাজি আছি।” বাবর জ্যোতিষীর কথা ভালোভাবে না বুঝেই তার কব্জি চেপে ধরে।
“আপনার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আপনাকে উৎসর্গ করতে হবে…”
“সেটা কি, কি সেটা?”
“সুলতান, সেটা কেবল আপনিই জানেন।”
বাবর ঘুরে দাঁড়ায় এবং মাতালের মতো টলতে টলতে দূর্গের মসজিদের দিকে এগিয়ে যায়। মিহরাবের খোদাই করে কারুকাজ করা কুলঙ্গির সামনের পাথরের মেঝেতে সে নামাজ পড়তে শুরু করে। চোখ বন্ধ নিজের সমস্ত একাগ্রতা একত্রিত করে সে। আল্লাহতা’লাকে প্রতিশ্রুতি দেয়: “আমার আত্মত্যাগ স্বীকার করো। আমার সন্তানের কষ্টের বোঝা আমাকে বহন করতে দাও। সে না, আমি, আমাকে মৃত্যুবরণ করতে দাও…আমার জীবন কবুল করো…”
*
তিন তিনটা দীর্ঘ দিন আর রাত, বাবর নিজের কামরা নিজেকে বন্দি করে রাখে। সব রাষ্ট্রীয় কাজ বাতিল করে জলপানি স্পর্শ না করে বসে থাকে সে জানে তার মাহামের কাছে যাওয়া উচিত। কিন্তু ছেলের জন্য তার দুশ্চিন্তার কথা ভেবে- বেচারীর একমাত্র ছেলে- নিজের উদ্বেগের উপরে সেটার কথা ভেবে সে বিহ্বল হয়ে পড়ে। কামরান আর আসকারীকে তাদের দূরতম প্রদেশেও সে খবর পাঠায় না। সে তাদের কি বলবে? হুমায়ুনের অসুস্থতার কথা, নাকি বলবে যে হেকিম সামান্যই আশা দিয়েছেন? সে যদি চিঠি পাঠায়ও তারা সময়মতো আগ্রায় উপস্থিত হতে পারবে না। আর তাছাড়া বাবরের কেন জানি একটা সন্দেহ হয়, যার কারণ সে বলতে পারবে না, যে কামরান আর আসকারী তাদের সৎ-ভাইয়ের অসুস্থতার খবর পেলে মোটেই ব্যাথিত হবে না।
আল্লাহতা’লা তার উৎসর্গ কেন গ্রহণ করছেন না? সে কেন এখনও শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে, যখন হুমায়ুনের জীবন প্রদীপ নিভে আসছে…? সময় গড়িয়ে যেতে বাবর হতাশ হয়ে পড়ে। যে ধরণের হতাশার সাথে তার পরিচয় ছিলো না। সে মনে মনে যাই ভাবতে চেষ্টা করুক, সময় গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে, তার জীবন প্রদীপ নিভুনিভু হবার কারণে তার মন ঘুরপাক খেয়ে। যদিও বাবুরীর মৃত্যুর পরে তার দেহের একটা অংশ মরে গিয়েছে বলে মনে হয়েছিলো, যেটা ছিলো ব্যক্তিগত শোক প্রস্তাব। হুমায়ুন যদি এখানে মারা যায়, তবে সেটা হবে একটা ব্যক্তিগত ক্ষতি- নিজের অন্য ছেলেদের চেয়ে হুমায়ুন তার সাথে অনেক ঘনিষ্ঠ- কিন্তু একই সাথে আরো বেশি কিছু। আল্লাহতালার এটার কুদরত এই যে লাঠির মাথাটা আজই বানিয়েছি, হুমায়ুন যদি মারা যায় সেটা হবে ব্যাক্তিগত অপূরণীয় ক্ষতি। আল্লাহতালার বলবার রীতিকে সবকিছু বলে, বাবর কায়মনোবাক্যে যা প্রার্থনা করছে, যা কিছু অর্জন করেছে সেসবের কোনই মূল্য নেই…সে জীবনেও হিন্দুস্তানে কোনো সাম্রাজ্য বা নিয়তি কোনোটার উপরেই ভরসা রাখতে পারবে না… তার এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে…বা নিদেনপক্ষে তৈমূরকে পেছনে ফেলার অভিপ্রায়ে এখানে থেকে গিয়ে ভুল করেছে। তার উচিত ছিলো অহঙ্কার না করে, নিজের দম্ভ প্রশমিত করে খাইবার গিরিপথের ওপারে নিজের ধূধূ করতে থাকা তেপান্তর নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাটা উচিত ছিলো।