বাবর বিছানায় উঠে বসে এবং রোজনামচার পাতায় কিছু একটা লিখতে চেষ্টা করে। কিন্তু শব্দ খুঁজে না পেয়ে সে তার রত্নখচিত দোয়াতদানী অস্থির ভঙ্গিতে ঠেলে সরিয়ে দেয়। জেনানামহলে গেলে সে হয়তো একটু স্বস্তি পেতে পারে। সে মাহামকে গান গাইতে বলতে পারে। সে মাঝে মাঝে এসান দৌলতের বৃত্তাকার পেট আর মিহি গলা বিশিষ্ট বীণা বাজায়। মাহাম তার নানীজানের মতো দক্ষ না, কিন্তু তারপরেও তার হাতে বীণাটা থেকে মিষ্টি আওয়াজ ঠিকই বেরিয়ে আসে। আবার হুমায়ুনের সাথে এক হাত দাবাও খেলা যায়। তার এই ছেলেটা বিচক্ষণ আর তীক্ষ্ণধী- কিন্তু হলেও, সে গর্বিত বোধ করে, সেই বা কম কিসে এমন একটা ভাব তার ভিতরে কাজ করে এবং সে এখনও তাকে হারাতে সক্ষম। প্রথাগত ভঙ্গিতে শাহ মাত বলে সে যখন বিজয়ের ঘোষণা দেয়, তখন হুমায়ুনের চোখের বিভ্রান্ত দৃষ্টি দেখতে তার ভালোই লাগে। তারা খেলা শেষে বাংলার শাসকদের বিরুদ্ধে বৃষ্টি থামার পরে যুদ্ধ যাত্রার বিষয়ে আলোচনা করে। গাঙ্গেয় অববাহিকায় তাদের নদীবেষ্টিত ভূখণ্ডে থেকে তারা মনে করেছে যে মোঘল আধিপত্য তারা অস্বীকার করতে পারবে এবং বাবরের সর্বময় কর্তৃত্ব নাকচ করবে।
“আমার বেটা হুমায়ুনকে ডেকে পাঠাও, আর দাবার ছক নিয়ে আসতে বলো।” বাবর এক পরিচারককে ডেকে বলে। আলস্য দূর করার অভিপ্রায়ে সে উঠে দাঁড়ায় এবং নদী দেখা যায় এমন একটা গবাক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে প্রমত্তা যমুনার বুকে উপচে পড়া পলিমাটি মিশ্রিত পানি বয়ে যেতে দেখে। প্রায় উপচে পড়া নদীর পাড় দিয়ে এক কৃষক তার হাডিডসার গরুর পাল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে বাবর ঘুরে দাঁড়ায়, নিজের ছেলেকে দেখবে বলে আশা করে, কিন্তু সাদা জোব্বা পরিহিত পরিচারককে দেখতে পায়।
“সুলতান, আপনার ছেলে আপনার মার্জনা প্রার্থনা করে বলেছেন যে, তার শরীরটা খারাপ এবং তিনি নিজের কক্ষ ত্যাগ করতে অপারগ।”
“তার আবার কি হলো?”
“সুলতান আমি সঠিক জানি না।”
হুমায়ুন কখনও অসুস্থ হয় না। সেও সম্ভবত বৃষ্টির সাথে আগত অসাড়তা থেকে কষ্ট পাচ্ছে, যা প্রাণশক্তি শুষে নেয় এবং প্রচণ্ড প্রাণবন্ত লোককেও ক্লান্ত করে তোলে।
“আমি তাকে দেখতে যাবো,” বাবর গায়ে একটা হলুদ আলখাল্লা জড়িয়ে নিয়ে ছাগলের চামড়ার তৈরি একটা নাগরা পায়ে গলিয়ে নেয়। তারপরে সে নিজের কক্ষ থেকে স্তম্ভযুক্ত আঙ্গিনার উল্টোদিকে অবস্থিত হুমায়ুনের কামরার দিকে এস্ত পায়ে এগিয়ে যায়। আঙ্গিনায় পদ্মফুলের মতো আকৃতির মার্বেলের ভোলা বেসিনে স্থাপিত ঝর্ণা থেকে পানির ধারা চকচকে বৃত্তচাপ তৈরি করে নির্গত হচ্ছে না, যেমনটা হবার কথা বরং এখন বৃষ্টির তোড়ে কানা উপচে গড়িয়ে পড়ছে।
হুমায়ুন নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। হাতটা মাথার উপরে দেয়া, চোখ বন্ধ, কপালে দানা দানা ঘাম জমে রয়েছে, ঠকঠক করে কাঁপছে। সে তার আব্বাজানের পায়ের শব্দে চোখ খুলে তাকায়। কিন্তু চোখ জবাফুলের মতো লাল হয়ে আছে। চোখের মণি জ্বরের ঘোরে ছলছল করছে। বাবর দূর থেকেই তার ভারী শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ পায়। প্রতিবার নিঃশ্বাস নেবার সময় তাকে রীতিমত প্রাণান্তকর পরিশ্রম করতে হয়, যা তাকে প্রায় কুঁকড়ে ফেলে।
“কখন থেকে তোমার এই অবস্থা?”
“আব্বাজান, আজ সকাল থেকে।”
“আমাকে কেন জানানো হয়নি?” বাবর তার ছেলের পরিচারকের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চায়। “এখুনি আমার হেকিমকে ডেকে আনতে লোক পাঠাও!” তারপরে সে তার নিজের রেশমের রুমাল পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে হুমায়ুনের কপাল মুছে দেয়। কপাল সাথে সাথে ঘেমে উঠে- বস্তুতপক্ষে, ঘামে তার সারা মুখ ভিজে রয়েছে এবং এখন যেনো তার কাঁপুনি আগের চেয়ে আরও বেড়ে গিয়েছে এবং দাঁতে দাঁতে ঠকঠক করে বাড়ি খায়।
“সুলতান, হেকিম এসেছেন।”
আব্দুল-মালিক কোনো কথা না বলে সাথে সাথে হুমায়ুনের শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কপালে হাত রাখে, চোখের পাতা টেনে দেখে এবং নাড়ী পরীক্ষা করে। তারপরে তার ভ্রু কুঁচকে উঠে, সে হুমায়ুনের আলখাল্লার সামনের অংশটা খুলে, এবং ঝুঁকে নিজের নিখুঁতভাবে পাগড়ি বাঁধা মাথাটা তার বুকের উপরে রেখে হৃৎস্পন্দন মনোযোগ দিয়ে শোনে।
“তার কি হয়েছে?”
আব্দুল-মালিক চুপ করে থাকে। “সুলতান, এই মুহূর্তে বলা দুষ্কর। আমাকে আরো ভালো করে পরীক্ষা করতে হবে।”
“তোমাকে কেবল তোমার ঐ অলক্ষুণে মুখটা ফাঁক করে কথা বলতে হবে…”
“আমি আমার সহকারীকে ডেকে পাঠিয়েছি। সুলতান, অভয় দিলে বলি আপনি বরং এখান থেকে এখন যান। আমি শাহজাদাকে ভালোমতো পরীক্ষা করে আপনাকে গিয়ে জানাবো- কিন্তু ব্যাপারটা গুরুতর সম্ভবত প্রাণঘাতী। তার নাড়ী আর হৃৎস্পন্দন দুর্বল আর দ্রুত।” বাবরের সাথে আর কোনো কথা না বলে সে তার রোগীর দিকে ফিরে দাঁড়ায়। বাবর ইতস্তত করে এবং ছেলের ঘামে ভেজা কাঁপতে থাকা মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে যায়। পরিচারক তার পেছনে দরজা টেনে বন্ধ করে দিলে সে বুঝতে পারে সে নিজেও কাঁপছে।
একটা হিমশীতল অনুভূতি তার হৃৎপিণ্ডকে জড়িয়ে ধরেছে। হুমায়ুনের জন্য সে কতবার শঙ্কিত হয়েছে। পানিপথে ইবরাহিম লোদীর একটা হাতির পায়ের নীচে সে চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিলো। খানুয়াতে সেই রাজপুত যোদ্ধার তরবারির কোপে তার প্রাণ সংহার হতে পারতো। কিন্তু সে কখনও ভাবেনি যে হুমায়ুন- এতো স্বাস্থ্যবান আর শক্তিশালী- অসুস্থতার কাছে পরাভব মানবে। তার প্রিয় ছেলে ছাড়া সে কিভাবে বেঁচে থাকবে? হুমায়ুন মারা গেলে হিন্দুস্তানের এই বিপুল বৈভব মূল্যহীন হয়ে যাবে। এই হাঁসফাঁস করা গরম আর বিষবৎ দেশে যেখানে কেবল বৃষ্টি আর বৃষ্টি এবং রক্তখেকো মশার ভনভনানি ছাড়া আর কিছু নেই। সে কখনও আসতো না, যদি একবার জানতে পারতো তাকে এভাবে এর মূল্যশোধ করতে হতে পারে।