“ছোট ভাইটি, সেটার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।”
“কি বলতে চাও?”
“আমার একজন লোকের উপরে দায়িত্ব রয়েছে মাস্কেটে গুলি ভরার। আমি তাকে বলেছি হুমায়ুনের বন্দুকের বারুদে ভেজাল মেশাতে। যাতে সেটা থেকে ঠিকমতো গুলি না হয়। সে যদি আহত নাও হয় লক্ষ্যভেদ তাকে আজ করতে হচ্ছে না। আব্বাজানের পান্নার আংটি হুমায়ুনের ভাগ্যে নেই…”
বাবর পিছিয়ে আসে। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয় সে স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু সে যা শুনেছে সেটা পুরোপুরি বাস্তব। সে এবার ইচ্ছা করেই জেড পাথরের বোলের গোলাপজল মেঝেতে ফেলে দেয়। শব্দটার ফলে সে যা আশা করেছিলো তাই হয়। কামরান আর আসকারী পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। “আমরা আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি আব্বাজান, তাই আপনার পরিচারকদের পাঠিয়ে দিয়ে আমরাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। নিশানাবাজির প্রতিযোগিতার সময় হয়ে এসেছে। নিশানা স্থাপন করা হয়েছে এবং মাস্কেটও তৈরি আছে। হুমায়ুন প্রস্তুত হয়ে দূর্গ প্রাঙ্গনে অপেক্ষা করছে।”
“কামরান আজ নিশানাবাজি হবে না, আমি মত পরিবর্তন করেছি।”
“কিন্তু আব্বাজান কেন…?”
“তুমি কি আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছো?”
“অবশ্যই না আব্বাজান।”
“তোমরা দুজনেই এখন বিদায় হও। আর আমার পরিচারকদের পাঠিয়ে দাও। ভোজসভায় তোমাদের সাথে আমার দেখা হবে।”
সন্ধ্যাবেলার অনুষ্ঠানের জন্য তার পরিচারকরা তাকে প্রস্তুত করতে থাকলে, বাবর খেয়ালই করে না তারা তারা সোনালী প্রান্তযুক্ত গাঢ় নীল রঙের জোব্বা তার ডান কাঁধে ফিরোজা রঙের গিট দিয়ে আটকাচ্ছে বা হাঁটু পর্যন্ত লম্বা বুট জুতার সাথে সোনালী জরির কাজ করা পাজামা পরাচ্ছে। যান্ত্রিক ভঙ্গিতে সে গলার মালা, পাগড়ির অলংকার, পছন্দ করে দেয়। তার হাতের তৈমূরের আংটি যেটা সে কখনও খোলে না- চমকায়। দৃশ্যটা সাধারণত তাকে প্রীত করে কিন্তু সেটা অন্য রাতের কথা।
সে চার বছর ধরে হিন্দুস্তানে রয়েছে। আজ রাতে সে তার নিজের লোকদের সাথে আহার করবে। পরে যমুনার উপরের আকাশে সুদূর কাশগর থেকে সে যেসব জাদুগরদের নিয়ে এসেছে তারা আতশবাজি নামে একটা বস্তুর সাহায্যে আকাশে কৃত্রিম তারার সৃষ্টি করবে। সে ইতিমধ্যে নিজে একবার দেখেছে এবং চকচক করতে থাকা আলোর ঝর্ণা ধারা রাতের নিকষ আকাশে ছুটে বেড়াচ্ছে দেখে তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এসেছিলো।
কিন্তু এখন সবকিছুই তার কাছে কলঙ্কপূর্ণ আর বেকার মনে হয়। তার ছেলেদের অপরিণত, নির্বোধ আর হঠকারী কথায় সে কষ্ট পায়নি তাদের কণ্ঠের বিষ তাকে ব্যথিত করেছে। সে যেটাকে ভাই ভাইয়ের ভিতরে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা ভেবেছিলো সেটা আসলে অন্য কিছু এবং সে নিজেই এর জন্য দায়ী। নিজের নতুন সাম্রাজ্যের প্রতি বেশি মনোযোগ দেবার কারণে সে খেয়ালই করেনি তার চারপাশে কি ঘটছে।
একজন শাসককে সবসময়ে সতর্ক থাকতে হবে।
এই কথাটা কি সে নিজের রোজনামচায় লিখেনি এবং এর কথাই কি সে হুমায়ুনকে বোঝাতে চেষ্টা করেনি। আর সে নিজেই কিনা নিজের উপদেশমতো কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাবরের চোয়াল কঠোর হয়ে উঠে। অনুষ্ঠান শেষ হবার সাথে সাথে, সে কামরান আর আসকারীকে হিন্দুস্তানের কোনো প্রদেশের শাসক নিয়োগ করবে। তাদের মস্তিষ্ক ব্যস্ত রাখার মতো প্রচুর কাজ আশেপাশে রয়েছে এবং সে নিজে তাদের এখন থেকে চোখে চোখে রাখবে। আর হুমায়ুনকে সে আগ্রার আশেপাশের এলাকার শাসকের দায়িত্ব দেবে যেখানে সে নিজে তাকে কাছে থেকে দেখতে পাবে। সে এখন থেকে তাকে তার সেইসব ক্লান্তিকর আধ্যাত্মিক আর নিঃসঙ্গতার প্রবণতা পরিহার করতে উৎসাহিত করবে এবং সাম্রাজ্যের কাজের দায়িত্ব নিতে বলবে। হুমায়ুন যদি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে, তবে সে প্রকাশ্য দরবারে তাকে তার উত্তরাধিকারী ঘোষণা করবে। কামরান আর আসকারীকে সেটা মেনে নিতে হবে। আর সেই সাথে ভাইয়ের সাথে খামোখা লড়াই করার প্রবণতাও তাদের পরিহার করতে হবে। হিন্দুস্তান অমিত সম্ভাবনার একটা দেশ। এর অধিকাংশ স্থানই এখনও জয়লাভ করা হয়নি। আর তারা এখানে হুমায়ুনের অনুগত হিসাবেই নিজেদের জন্য উপযুক্ত স্থান সৃষ্টি করতে পারবে। পিতলের বার্নিশ করা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের সাজসজ্জার দিকে তাকিয়ে, বাবর ভাবে, ভাগ্য ভালো তার নিজের বয়স এখনও অল্প। ইনশাল্লা, আল্লাহতালার করুণায়, সে তার সন্তানদের মাঝে বিদ্যমান রেষারেষি দূর করতে পারবে এবং তাদের পরস্পর বিরোধী উচ্চাকাঙ্ক্ষার ভিতরে একটা সমন্বয় সাধন করতে পারবে।
৪.৮ নিভে আসা আলোর দীপ্তি
২৭. নিভে আসা আলোর দীপ্তি
বাবরের মাথার ভেতর কেউ যেনো অবিরাম হাতুড়ি পিটিয়ে চলেছে যা বর্ষাকালের শুরু থেকেই তাকে বিব্রত করছে। আজ নিয়ে তিনদিন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু এখনও ভারী বাতাসে স্বস্তির কোনো খোঁজ নেই। কয়েকদিন এমনকি মাসব্যাপী নাগাড়ে বৃষ্টি পড়তে পারে। আগ্রা দূর্গে তার শয়নকক্ষে রেশমী তাকিয়ায় হেলান দিয়ে সে ফারগানার বেশতর পর্বতের রুক্ষ্ম চূড়ার উপর দিয়ে বয়ে আসা মিহি শীতল বৃষ্টির কথা ভাবতে চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হয়। তার মাথার উপরের পাঙ্খা দ্বারা সামান্যই বাতাস আলোড়িত হয়। গরম অনুভব না করার অনুভূতি কেমন সেটাই আজকাল কল্পনা করাটা কঠিন। তার নিজের হাতে তৈরি করা উদ্যানেও এখন আর বেড়াতে ভালো লাগে না। কাদায় প্যাঁচপেচে মাটি, পানিতে ভিজে ভারী হওয়া ফুল এবং নহর দিয়ে উপচে বইতে থাকা পানির স্রোত তাকে আরও বিষণ্ণ করে তোলে।